বিজ্ঞান গবেষণা ও বাঙালি বিজ্ঞানী

বাংলা রচনা

ভূমিকা:

সুপ্রাচীন কাল থেকেই বিজ্ঞানের অগ্রগতি ভারতীয় সভ্যতা কে সমৃদ্ধ করেছে , সেক্ষেত্রে বিজ্ঞান গবেষণা ও বাঙালি বিজ্ঞানীর অবদানও উপেক্ষণীয় নয় ৷ চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাং এর বিবরণে বাংলার প্রাচীন বৌদ্ধবিহারগুলিতে বিজ্ঞান চর্চার উল্লেখ রয়েছে ৷ চক্রপাণি দত্তের চরক ও শুশ্রুতের ওপারে লেখা বই ‘আয়ুর্বেদ দীপিকা’ এবং ‘ভানুমতী’, শুরপালের ‘বৃক্ষায়ুর্বেদ‘ এবং ‘লৌহ পদ্ধতি’ বিজ্ঞানসাধনার অন্যতম প্রাচীন নিদর্শন৷

বাংলায় আধুনিক বিজ্ঞান সাধনার ধারা :

আধুনিক বিশ্বের বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রেও বাঙালি পিছিয়ে নেই ৷ উনিশ শতকে ঔপনিবেশিক বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার বাঙালির জ্ঞানচর্চা এবং বিজ্ঞান সাধনার ক্ষেত্রটিকে প্রসারিত করে দেয়। ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত বাঙালির বিজ্ঞানচর্চাকে অনুপ্রাণিত করে। কলকাতা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত এই ধারায় আর একটি মাত্রা যোগ করে। এই কলেজের শিক্ষক মধুসূদন গুপ্ত তাঁর ছাত্রদের নিয়ে ১৮৩৬ খ্রীস্টাব্দে সর্বপ্রথম শবব্যবচ্ছেদ করে বাঙালির বিজ্ঞানচর্চার জয়যাত্রা সূচিত করেন।

১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে ডা. মহেন্দ্রলাল সরকার কর্তৃক প্রতিষ্টিত ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দি কাল্টিভেশন অব সায়েন্স’ বাঙালির বিজ্ঞানসাধনাকে প্রথম সংহত রূপ দেয়। আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু বিনা তারে বিদ্যুৎ তরঙ্গ পাঠিয়ে বেতারবার্তা আবিষ্কার করেন । ‘কেস্কোগ্রাফ’ যন্ত্রের সাহায্যে উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও অনুভূতি ক্ষমতাকে প্রমাণ করেন তিনি। এছাড়াও স্ফিগমোগ্রাফ, পোটোমিটার, ফটোসিন্থেটিক বাবলার তাঁর যুগান্তকারী আবিষ্কার । ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে ‘বসু বিজ্ঞান মন্দির প্রতিষ্ঠা করে তিনি বাঙালির বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্র কে সমৃদ্ধ করেন। তাঁর হিন্দু রসায়ন শাস্ত্রের ইতিহাস’, life and Experiences of a Bengali Chemist’, ‘বাঙালির মস্তিষ্ক ও তাহার অপব্যবহার ‘,’অন্নসমস্যায় বাঙালির পরাজয় ও তাহার প্রতিকার ‘ প্রভৃতি গ্রন্থ বিজ্ঞান চর্চার ইতিহাসের স্মরণযোগ্য। তিনি ছিলেন ভারতবর্ষের প্রথম ফার্মাসিউটিক্যাল কম্পানি ‘বেঙ্গল কেমিক্যালস অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল’ এর প্রতিষ্ঠাতা। তাঁরই উদ্যোগে ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে ইন্ডিয়ান কেমিক্যাল সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয়। নীলরতন ধর,রসিকলাল দত্ত ,পুলিনবিহারী সরকার প্রমুখ ও বিজ্ঞান সাধনায় বিশেষ খ্যাতি লাভ করেন।

সত্যেন্দ্রনাথ বসুর আবিষ্কার ‘বোস সংখ্যায়ন তত্ত্ব‘ বিশ্বব্যাপী এক অদ্ভুত পূর্ব উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। মেঘনাথ সাহার তাপীয় সমীকরণ সূত্র পরিমাণু গবেষণায় নতুন দিগন্ত খুলে দেয়। তাঁর প্রতিষ্টিত’ ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স’ আজও পরমাণু বিষয়ক গবেষণার কাজ সফলভাবে চালিয়ে যাচ্ছে । প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ প্রতিষ্ঠিত ‘ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট‘ পরিসংখ্যানবিদ্যাচর্চার পীঠস্থান।

গণিতশাস্ত্রে রাধানাথ শিকদার, পদার্থবিদ্যায় শিশির কুমার মিত্র, নৃতত্ত্ব বিজ্ঞানে নির্মল কুমার বসু এবং প্রত্নতত্ত্ববিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের নামও বাঙালির বিজ্ঞানসাধনার ইতিহাসে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। চিকিৎসা বিজ্ঞানী উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী কালাজ্বরের প্রতিষেধক ইউরিয়া স্টিবামাইন আবিষ্কার করেছিলেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে নীলরতন সরকার, রাধাগোবিন্দ কর, কাদম্বিনী বসু, মহেন্দ্রলাল সরকার ,লালমাধব মুখোপাধ্যায়, বিধানচন্দ্র রায় ,বনবিহারী মুখোপাধ্যায়, সুরেশ প্রসাদ সর্বাধিকারি, গিরীন্দ্রশেখর বসু, মহেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখিত।

Read : দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞান

বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় সাড়া জাগানো কয়েকজন বৈজ্ঞানিক ও হলেন দেবেন্দ্রমোহন বসু, প্রিয়দারঞ্জন রায়, জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, ইন্দুমাধব মল্লিক, শিশিরকুমার মিত্র প্রমুখ। সাম্প্রতিককালে বিজ্ঞানী হিসেবে ড. মনি ভৌমিক, ড. অসীমা চট্টোপাধ্যায়, ড. আনন্দমোহন চক্রবর্তী, ড. সুভাষ মুখ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ এর নাম বিশ্বজুড়ে স্বীকৃতি ও অর্জন করেছে।

উপসংহার :

বসু বিজ্ঞান মন্দির, সাহা ইন্সিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স, ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অব সায়েন্স প্রভূতি প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে বাঙালি আজও বিজ্ঞানসাধনায় নিমগ্ন। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার ধারাটিও যথেষ্ট প্রাণবান। দিগদর্শন, সমাচার দর্পণ, তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা থেকে বিজ্ঞান নির্ভর সাহিত্য রচনাযর যে জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল তা ক্রমে ‘জ্ঞান ও বিজ্ঞান’, ‘সন্দেশ’, ‘আশ্চার্য’, ‘ফ্যান্টাস্টিক’, ‘কিশোর জ্ঞানবিজ্ঞান’ প্রভৃতির পৃষ্ঠায় পল্লবিত হয়ে উঠেছে। ঠাকুর পরিবারের বহুগুণী মানুষের বিজ্ঞান বিষয়ক রচনা সম্ভার বাংলা সাহিত্যের এক অক্ষয় সম্পদ। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অক্ষয়কুমার দত্ত, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, জগদীশচন্দ্র বসু, জগদানন্দ রায়, চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য্য ,গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য প্রমুখ বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার ধারাকে সমৃদ্ধ করেছেন। বিজ্ঞানশিক্ষা, বিজ্ঞানচর্চা ও গবেষণার ক্ষেত্র আজ বহুধাবিস্তৃত । বিজ্ঞানের নানা শাখায় বহু বাঙালি বিজ্ঞানী অত্যন্ত সুনাম ও দক্ষতার সঙ্গে সারাবিশ্বে নিরন্তর গবেষণায় ব্যাপৃত রয়েছেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Posts
Scroll to Top