বিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা

বিদ্যালয় জীবনে ক্রীড়া প্রতিযোগিতার একটি বিশেষ স্থান রয়েছে। খেলার মাধ্যমে সহযোগিতার মনোভাব তৈরি থেকে চরিত্র গঠন পর্যন্ত, এই রচনাটি বার্ষিক ক্রীড়া দিবসের গুরুত্ব এবং ছাত্রজীবনে এর অপরিহার্যতা তুলে ধরে।
বিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় উৎসাহী দর্শক হিসেবে ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক ও অভিভাবকরা।

ভূমিকা

মানুষ একটি সামাজিক প্রাণী, এবং এই সামাজিকতার বিকাশ ও পরিপূর্ণতার জন্য শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। কিন্তু এই শিক্ষা যদি কেবল মাত্র বই-খাতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে যায়, তবে সম্পূর্ণ বিকাশ সম্ভব হয় না। একজন মানুষের দৈহিক ও মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি সমাজে বসবাসের উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য খেলাধুলা বা ক্রীড়া শিক্ষার একটি অপরিহার্য অঙ্গ। একজন ছাত্রছাত্রীর জীবনে গড়ে ওঠা অনেক গুরুত্বপূর্ণ গুণের- যেমন সহযোগিতা, শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা, আত্মবিশ্বাস, এবং পরাজয়কে মেনে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা – বিকাশ ঘটে খেলাধুলার মাধ্যমে।

বিদ্যালয়ে ক্রীড়ার স্থান

প্রকৃত অর্থেই শিক্ষাই শিক্ষার্থীদের পরিপূর্ণ মানুষ করে গড়ে তোলে। তাই বর্তমান বিশ্বের প্রায় সকল বিদ্যালয়েই শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে ক্রীড়াকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়। সপ্তাহের নির্দিষ্ট কিছু সময় শ্রেণিকক্ষের পড়াশোনা থেকে অবকাশ নিয়ে বিদ্যালয়ের মাঠে ছাত্রছাত্রীরা নানাবিধ খেলায় তাদের দক্ষতা যাচাই করে, প্রতিভা বিকশিত করে। এই নিয়মিত শারীরিক চর্চা যেখানে তাদের ক্লান্তি দূর করে কর্মোদ্দীপনা যোগায়, সেখানে দলবদ্ধ হয়ে কোন খেলায় অংশগ্রহণ তাদেরকে শেখায় কীভাবে একসাথে কাজ করতে হয়, নিজেদের মধ্যে সমন্বয় বজায় রাখতে হয়। বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা মূলত এই সারা বছরের অনুশীলন ও অর্জনের মূল্যায়ন করে।

ক্রীড়া প্রতিযোগিতার সময় নির্ধারণ

বিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজনের কোনও নির্দিষ্ট নিয়ম না থাকলেও, চেষ্টা করা হয় যাতে এই প্রতিযোগিতার জন্য পড়াশোনার চাপ একটু কম থাকে। এজন্য অনেক বিদ্যালয় বার্ষিক পরীক্ষার পর ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজন করে থাকে। আবার বছরের শুরুতেও অনেক বিদ্যালয়ে এই প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে আসলে পূর্ববর্তী বছরের ক্রীড়া-কৌশলের মূল্যায়ন হয়। প্রতিযোগিতার তারিখ নির্ধারিত হবার অনেক আগে থেকেই এর পেছনে প্রস্তুতি শুরু করে দেওয়া হয়।

প্রস্তুতি পর্ব

ক্রীড়া প্রতিযোগিতার অনেক আগে থেকেই এর নানামুখী প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। বিদ্যালয়ের ক্রীড়া শিক্ষকের নেতৃত্বে প্রতিযোগিতা পরিচালনার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। অন্যান্য শিক্ষদের মধ্যে থেকে নির্বাচিত সদস্যরা এই কমিটির নানাবিধ দায়িত্ব পালন করেন। কমিটি প্রথমে ঠিক করে কোন কোন খেলা বা ইভেন্ট প্রতিযোগিতার অন্তর্ভুক্ত হবে। আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে যেসব ক্রীড়া অনুষ্ঠিত হয়, তার পাশাপাশি মজার কিছু ইভেন্টও রাখা হয় সবার অংশগ্রহণের জন্য।

এরপর শুরু হয় ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে থেকে প্রতিযোগী বাছাইয়ের পালা। কয়েক সপ্তাহ ধরে সবাইকে বিভিন্ন খেলা বা ইভেন্টে নিজেদের দক্ষতা দেখানোর সুযোগ দেওয়া হয়। ক্রীড়াশিক্ষক ও কমিটির অন্যান্য সদস্যরা মিলে শেষ পর্যন্ত নির্ধারণ করেন কোন ছাত্র বা ছাত্রী কোন ইভেন্টে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে।

ক্রীড়া প্রতিযোগিতার উদ্বোধন

বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার দিনটি সকলের জন্যই থাকে উৎসাহ আর উদ্দীপনায় পরিপূর্ণ। ভোর থেকেই বিদ্যালয়ের মাঠকে সাজানোর কাজ শুরু হয়ে যায়। নানা রঙের পতাকা আর ফেস্টুনে সেজে ওঠে খেলার মাঠ। মাঠের একপাশে তৈরি হয় মঞ্চ। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, বিশেষ অতিথি, এবং ক্রীড়া পরিচালনা কমিটির সদস্যদের বসার জন্য রাখা হয় চেয়ার। তার সামনে থাকে টেবিলের উপর সাজানো বিজয়ীদের নানাবিধ পুরস্কার। তার ঠিক বিপরীতে মাঠের মাঝখানে খাড়া থাকে বিজয় স্তম্ভ যেখানে পতাকা উত্তোলন করা হবে।

সকাল সাড়ে আটটা বা নয়টার দিকে অতিথি, শিক্ষক-শিক্ষিকা, ছাত্রছাত্রী, এমনকি এলাকার অনেক দর্শকের সমাগমে ক্রীড়া প্রতিযোগিতার মাঠ পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। শুরুতেই পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠান ও জাতীয় সংগীত পরিবেশিত হয়। ক্রীড়া কমিটির সদস্যরা নির্ধারিত পোশাক পরে কুচকাওয়াজে অংশগ্রহণ করে সকলকে সম্মান জানায়। মশাল হাতে নিয়ে কিছু নির্বাচিত ছাত্র মূল মঞ্চ পর্যন্ত দৌড়ে এসে ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আনুষ্ঠানিক সূচনা করে। এরপর সব প্রতিযোগী দল সারিবদ্ধভাবে নিজ নিজ দলনেতার নেতৃত্বে সামনে এসে শারীরিক কসরত প্রদর্শন করে এবং শপথবাক্য পাঠ করে। শপথে উচ্চারিত হয় সুষ্ঠু প্রতিদ্বন্দ্বিতা বজায় রাখা, ক্রীড়াসুলভ মনোভাব নিয়ে অংশগ্রহণ করা, এবং পরাজয়কে মেনে নিয়ে নিজেদের জয়ের জন্য আরও সুচিন্তিত পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়গুলি।

প্রতিযোগিতাসমূহের বর্ণনা

বিদ্যালয়ের এই বিশেষ দিনে নিয়মিত ক্লাস বন্ধ থাকে। এমনকি অন্যান্য সময় মাঠে খেলা করতে নিষেধ থাকলেও, আজ সকলের জন্যই মাঠ উন্মুক্ত। সমস্ত সাজসজ্জা এবং আনুষ্ঠানিকতার পর পূর্ব-নির্ধারিত তালিকা অনুযায়ী একটি একটি করে ইভেন্ট অনুষ্ঠিত হতে থাকে। আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসারে দৌড় প্রতিযোগিতা, লং জাম্প, হাই জাম্প, শটপুট, ডিসকাস, জ্যাভেলিন ইত্যাদি ইভেন্টে ছাত্রছাত্রীরা তাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে মরিয়া হয়ে ওঠে।

শুধুমাত্র এইসব নিয়মবদ্ধ ইভেন্ট‌ই নয়, দর্শক ও সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের বিশেষ আনন্দের জন্য কিছু মজার ইভেন্টেরও আয়োজন করা হয়। তিনপায়ে দৌড়, মোরগ লড়াই, বস্তা দৌড়, লজেন্স দৌড় এগুলো সকলের মধ্যে হাসি আর সাথে উত্তেজনারও সঞ্চার করে। এমনকি শিক্ষকদের জন্য হাঁড়িভাঙ্গা, দৌড় ইত্যাদির বন্দোবস্ত থাকে, যা দেখে উপস্থিত সকলেই রীতিমতো উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন। ছাত্রদের মধ্যে অনেক লুকিয়ে থাকা অদ্ভুত প্রতিভা প্রকাশের সুযোগ করে দেয় “মনের মতো সাজো” প্রতিযোগিতা। একটু হাসি ঠাট্টার মাধ্যমে এই ক্রীড়া উৎসব আরও একটু প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।

পুরস্কার বিতরণ এবং সমাপনী ভাষণ

সারাদিন ধরে চলা ইভেন্টগুলো বিকেলের দিকে সমাপ্তির পথে এগিয়ে আসে। দর্শক আর ছাত্র-ছাত্রীদের উত্তেজনা থাকে একেবারে তুঙ্গে – কে বা কারা হতে চলেছে এই বছরের বিজয়ী! ক্রীড়া পরিচালনা কমিটি দ্রুত ফলাফলের তালিকা তৈরি করে নেয়। সন্ধ্যার আগে মঞ্চে এক বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় পুরস্কার বিতরণের জন্য।

প্রথমে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অথবা অন্য কোন বিশিষ্ট শিক্ষক বিজয়ীদের অভিনন্দন জানিয়ে একটি ছোট ভাষণ দেন। এরপর প্রধান অতিথি, যিনি বিশেষভাবে আমন্ত্রিত হন এই অনুষ্ঠানের জন্য, তিনি সবার উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন। সাধারণত উনি খেলাধুলার উপকারিতা এবং শিক্ষার্থীদের জীবনে এর গুরুত্ব সম্পর্কে বলেন। এছাড়াও জীবনের নানাবিধ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে কিছু অনুপ্রেরণামূলক কথা শোনান।

তারপর আসে সেই মুহূর্তের জন্য সকলে অপেক্ষা করে— পুরস্কার বিতরণ। ক্রীড়া শিক্ষক প্রতিটি ইভেন্টের প্রথম, দ্বিতীয়, এবং তৃতীয় স্থানাধিকারী প্রতিযোগীদের নাম ঘোষণা করেন, এবং বিজয়ীরা সম্মানের সাথে প্রধান অতিথির কাছ থেকে নির্ধারিত পুরস্কার গ্রহণ করে। সমস্ত বিজয়ীর গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হয় মেডেল। সমবেত ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষকমণ্ডলী, অতিথি, অভিভাবক আর এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ— সকলেই করতালি আর হর্ষধ্বনির মাধ্যমে এই বিজয়ের আনন্দ উদযাপন করেন। যারা বিজয়ী হতে পারেনি, তারাও পিছিয়ে থাকে না। সহপাঠীদের সাফল্যে তারাও আপ্লুত হয়, এবং ভবিষ্যতে জেতার জন্য নিজেকে পরিশ্রম করে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখে।

উপসংহার

বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা এইভাবে একটি বিদ্যালয়ের উল্লেখযোগ্য উৎসব হয়ে ওঠে। শুধু যে এতে শারীরিক বিকাশ ঘটে তাই নয়, ছাত্র-ছাত্রীদের দায়িত্ববোধ, সহযোগিতার মনোভাব, পরিশ্রমের মূল্য সম্পর্কে সচেতনতা— সব মিলিয়ে ভবিষ্যতের পথ চলার জন্য মানসিকভাবে তাদেরকে আরও দৃঢ় করে তোলে। বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় কীভাবে হার-জিত, ব্যর্থতা-সাফল্য, হতাশা-আনন্দ এগুলো সবই জীবনেরই এক একটি উপাদান। যেকোন প্রতিযোগিতার আসল জয় নিজের ক্ষমতার শ্রেষ্ঠতাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টাতেই, আর অন্যকে পরাজিত করার মানসিকতা থেকে অনেক উঁচুতে এই ক্রীড়া অনুষ্ঠান।

একটি সুন্দর সাজানো মাঠ, অংশগ্রহণকারীদের উচ্ছ্বাস, দর্শকদের আগ্রহ, শিক্ষক আর ক্রীড়া কমিটির সদস্যদের নিরলস পরিশ্রম — সবকিছু মিলিয়ে যে আনন্দ ও স্মৃতির সৃষ্টি হয় তা সহজে ভোলার নয়। বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা শিক্ষার্থীদের শুধু সুস্থ প্রতিযোগিতার গুণ শেখায় না, সামগ্রিকভাবে অনেক বেশি পরিণত করেও তোলে।

Read More: চরিত্র গঠনে খেলাধূলার ভূমিকা ( The Role of Sports in Character Formation)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Posts
Scroll to Top