ভূমিকা
‘আজকের শিশু,পৃথিবীর আলােয় এসেছে
আমরা তার তরে একটা সাজানাে বাগান চাই’।
প্রবীণ শিল্পীর দরদভরা কণ্ঠে গান হয়ে একটি দাবিই উথিত – শিশুর জন্য চাই সুন্দর পৃথিবী। চাই শিশুর অধিকার আজ সবার সােচ্চার কণ্ঠে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। আজকে যে শিশুটি জন্ম নিল একদিন সেই তাে বড় হয়ে নামকরা সাহিত্যিক, স্বনামধন্য ডাক্তার, খ্যাতিমান শিল্পী বা বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী হবে। কিন্তু কী দেখছি আমরা? তৃতীয় বিশ্বের শিশুদের দিকে তাকালে তাদের নানা করুণচিত্র আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তারা ক্ষুধায় পায় না অন্ন, চিকিৎসার জন্য পায় না ওষুধ। শুধু তাই নয়- বাসস্থান ও শিক্ষার মতাে মৌলিক অধিকারগুলাে থেকেও তারা বঞ্চিত। এসব শিশুর কতজন কলে – কারখানায়, ক্ষেতে-খামারে শ্রমিকের কাজ করে, কতজন টোকাই, কতজন ক্ষুধা-অপুষ্টি আর রােগের কবলে পড়ে অকালে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়, কে রাখে তাদের খবর?
বিশ্ব শিশু দিবস কী
জাতিসংঘ ১৯৫৪ সালে এ দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বাংলাদেশে প্রতিবছর অক্টোবর মাসের প্রথম সোমবার ‘বিশ্ব শিশু দিবস’ পালন করা হয়ে থাকে। তবে বিভিন্ন আঞ্চলিকভাবে (বিশ্ব শিশু দিবস ২০শে নভেম্বর উদযাপন করা হয়, এবং আন্তর্জাতিক শিশু দিবস ১লা জুন উদযাপন করা হয। এ দিবস পালনের উদ্দেশ্য হল শিশু-কিশােরদের সঠিকভাবে গড়ে তুলতে হবে ও তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের পথনির্দেশ দিতে হবে।
শিশু দিবসের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
ছবিঃ ইন্টারনেট। |
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকাময় ও বেদনাদায়ক স্মৃতি এ দিবসটির জন্ম দেয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরােপে শত শত ফুলের মত নিস্পাপ শিশু মারা যায়। অনেক বড় শহর ধ্বংসস্থূপে পরিণত হয়। হাজার হাজার শিশু অসহায় ও পিতৃমাতৃহীন হয়ে পড়ে। পঙ্গু ও বিকলাঙ্গ হয় অনেকে।
জাতিসংঘ কল্যাণ তহবিল (UNICEF) এই অসহায় শিশুদের কল্যাণ ও নিরাপত্তা বিধানে এগিয়ে আসে এবং বিশ্ববাসীর মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে একটি দিবস পালনের প্রয়ােজন উপলদ্ধি করে। এ দিন সামগ্রিক আলােচনার মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিশুদের সমস্যাবলি বিশ্ব ফোরাম তুলে ধরে এবং সমাধানের পথ খুঁজে বের করে। তাই জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৫৪ সালে বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
শিশু দিবসের তাৎপর্য
বিশ্ব শিশু দিবসের তাৎপর্য গভীর ও ব্যাপক। এ দিবসটি পালনের উদ্দেশ্য হচ্ছে শিশুদের কল্যাণ সাধন এবং তাদের নানাবিধ সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান করে তাদের মৌলিক অধিকার আদায় করা। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ এখনও ‘বিশ্ব শিশু দিবস’ সম্পর্কে সচেতন নয়। এর জন্যে এ দিবসটির কর্মসূচি এমনভাবে করতে হবে যেন জনগণ এর তাৎপর্য গভীরভাবে অনুধাবন করতে পারে। কেবল কাগজে-কলমে শিশুদের অধিকারের কথা লিখে সুফল পাওয়া সম্ভব নয়। বাস্তবে এর রূপ দিতে হবে। এর জন্যে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে, এগিয়ে আসতে হবে আমাদের সবার। তৃতীয় বিশ্বের সন্তানদের দিকে তাকালে একটা বিষয়ই ধরা পড়ে বিশ্ব শিশু দিবস, শিশু সনদ ইত্যাদি যেন আমাদের সন্তানদের জন্যই করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এর প্রয়ােগ কতটুকু তা ভাববার বিষয়।
শিশু সনদ
প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই প্রতিবছর বিশ্ব শিশু দিবস মহা ধুমধামে পালিত হয়ে আসছে। সম্মিলিত জাতিসংঘে ১৯৫৯ সালে ‘শিশু অধিকার সনদ’ ঘােষণা করা হয়।
এ সনদ ‘শিশু অধিকার সনদ-৯০’ নামে পরিচিত। সনদের বিষয়বস্তুগুলাে হল :
(১) শিশুর সংজ্ঞার্থ,
(২) বৈষম্যহীনতা,
(৩) শিশু স্বাস্থ্যের প্রাধান্য,
(৪) শিশু অধিকার বাস্তবায়ন,
(৫) মাতা-পিতার অধিকার ও দায়িত্ব,
(৬) জীবনধারণ ও রক্ষা,
(৭) নাম ও জাতীয়তা,
(৮) পরিচয় সংরক্ষণ,
(৯) মাতা-পিতার সঙ্গে অবস্থানের অধিকার,
(১০) পারিবারিক পুনর্মিলন,
(১১) অবৈধ স্থানান্তর,
(১২) মত প্রকাশের স্বাধীনতা,
(১৩) তথ্য আদান-প্রদানের স্বাধীনতা,
(১৪) ধর্ম পালনের অধিকার,
(১৫) মেলামেশায় স্বাধীনতা,
(১৬) ব্যক্তিগত জীবন ,
(১৭) তথ্য ও গণমাধ্যম খ্যাতি,
(১৮) অনাচার ও অবহেলা রােধ,
(১৯) মাতা-পিতার অবর্তমানে বিকল্প যত্ন,
(২০) উদ্যোগ গ্রহণ,
(২১) উদ্বাস্তু শিশু,
(২২) অক্ষম শিশু,
(২৩) স্বাস্থ্য পরিচর্যা,
(২৪) সামাজিক পর্যালােচনা,
(২৫) সামাজিক নিরাপত্তা,
(২৬) জীবন-যাপনের মান
(২৭) শিক্ষা।
শিশুরা জাতির ভবিষ্যৎ
আজকের শিশু আগামী দিনে দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার। একটি নবজাত শিশুর মধ্যে আজ যে প্রাণের সঞ্চার হল তা একদিন ফুলে ফলে প্রস্ফুটিত হবে। বড় হয়ে একদিন সে জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা ও ভবিষ্যৎ স্বপ্ন সফল করবে। Wordsworth-এর ভাষায়- ‘Child is the father of a nation’. বস্তুত শিশুর মধ্যে নিহিত রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা। কারণ, শিশুই একদিন বড় হয়ে দেশ ও সমাজের দায়িত্ব গ্রহণ করবে। তারা হবে দেশের আদর্শ নাগরিক। এ জন্য চাই শিশুর সযত্ন প্রতিপালন, বিকাশ সাধনের সুষ্ঠু পরিবেশ। শিশুদের আদর, সােহাগ, যত্ন ও সুশিক্ষা দিয়ে বড় করে তােলার জন্য চাই অনুকূল পরিবেশ, উপযুক্ত শিক্ষা। উপযুক্ত অভিভাবক পেলে একটি শিশু আদর্শ মানুষরুপে বড় হয়ে উঠতে পারে। শিশু মন ফুলের মতাে পবিত্র, সরল। সে যে পরিবেশে থাকে সে তার পারিপার্শ্বিক আচার-আচরণ অনুকরণ করে এবং তাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। একটি নির্মল ফুলের মতাে পবিত্র শিশু ভালাে পরিবেশ ও উপযুক্ত শিক্ষার অভাবে, কুরুচিপূর্ণ পরিবেশ , অসৎসঙ্গ ও বিবেচনাহীন অভিভাবকের অধীনে বড় হয়ে অমানুষ, বিবেকহীন ও লম্পট চরিত্রের হতে আরে! সম্ভাবনাময় আগামী দিনের এক সুনাগরিক এভাবেই অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যেতে পারে।
পক্ষান্তরে সুশিক্ষা, সুরুচি, শিক্ষিত বিবেকবান অভিভাবক একটি শিশুর অন্তর সুপ্ত ভবিষ্যতের পিতাকে জাগিয়ে তুলতে পারে। এর ফলে জাতি পেতে পারে একজন আদর্শ চরিত্রবান নাগরিক, যার দ্বারা দেশ ও সমাজ সঠিক পথে চালিত হতে পারে। আর উন্নত চরিত্র, মহান মানুষের সমবায়েই একটি মহৎ জাতি গড়ে ওঠে। যেহেতু শিশুর মধ্যে জাতির উন্নতি ও সমৃদ্ধির বীজ লুকায়িত থাকে, তাই শিশু সযত্ন প্রতিপালন, সুশিক্ষা ও চরিত্র গঠনে প্রত্যেক অভিভাবককে দায়িত্ব নিতে হবে এবং এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়ােজন।
শিশুদের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য
বিশ্বের মােট জনসংখ্যার শতকরা ২৫ ভাগই শিশু। এটা পরম সত্য যে, শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ এবং আগামী দিনের রাষ্ট্রনায়ক। তারাই একদিন সুনাগরিক হয়ে দেশের নেতৃত্ব দেবে। তাই তারা অবহেলিত থাকলে আবষ্যৎ প্রজন্ম মুখ থুবড়ে পড়বে। এহেন ভয়াবহ অবস্থার কবল থেকে মুক্তি লাভের জন্য বিশ্বের প্রতিটি দেশই শিশু সমাজকে নিয়ে চিন্তা-ভাবনা শুরু করেছে। কী করে এদের সুন্দর করে গড়ে তোলা যায়, কীভাবে এদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা যায়। সুন্দর মানব-সমাজ গড়ে তােলার উদ্দেশ্যে শিশুকে গড়তে হবে। কারণ, শিশুর প্রতি অযত্ন অবহেলা কোনাে বিবেকবান মানুষেরই কাম্য নয়।
বিশ্বে শিশুদের অবস্থান
জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত শিশু অধিকারগুলাে সবদেশেই স্বীকৃতি পেয়েছে। কিন্তু স্বীকৃতিদানকারী বহু দেশে এ অধিকারগুলাে নানা কারণে বাস্তবায়িত হয়নি। বিশ্বের একটি অংশের শিশুরা যেসব অধিকার ভােগ করছে অপর। অংশের শিশুরা তা থেকে বঞ্চিত থাকছে। সেসব অধিকার ভােগের কোনাে সুযােগই তাদের নেই। তারা পাচ্ছে না ক্ষুধায় অন্ন, পরনের কাপড়, স্বাস্থ্য আর শিক্ষার সুবিধা। সমগ্র বিশ্বে অধিকারবঞ্চিত শিশুর সংখ্যা বর্তমানে একশত কোটিরও বেশি। এমনকী অনেক মানবসন্তান আছে যারা বেঁচে থাকার ন্যূনতম অধিকারটুকু পাচ্ছে না। বিশেষ করে আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলােতে এমনি অবহেলিত ও অধিকারবঞ্চিত শিশুর সংখ্যাই সর্বাধিক। আর সারা বিশ্বে অপুষ্টিতে ভুগে প্রতিবছর প্রায় তিন লাখ শিশু অকালে মৃত্যু বরণ করে।
বাংলাদেশে শিশুদের বর্তমান অবস্থা
জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদের ধারাগুলাে সবদেশ মেনে নিলেও বিশ্বের উন্নয়নশীল গরিব দেশগুলাে অর্থনৈতিক কারণে ধারাগুলাে পুরােপুরি কার্যকর করতে পারছে না। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় পাঁচ কোটি শিশু-কিশাের রয়েছে। এদের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, স্বাস্থ্য, বাসস্থান ও শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকার গুলো নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না।
ছবিঃ ইন্টারনেট। |
শুধু বাংলাদেশেই নয়, ভারত, নেপাল, বার্মা, মালয়েশিয়া, শ্রীলংকা ইত্যাদি কোনাে দেশেই শিশু অধিকার দল পুরোপুরি কার্যকর করা সম্ভব হয় নি। এর মূল কারণ হচ্ছে দারিদ্র্য, অর্থনৈতিক সংকট ও জনসংখ্যা বৃদ্ধি। তবে চরম হতাশার মধ্যেও আশার কথা এই যে, ইতোমধ্যেই বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দ্বারা কলে-কারখানায় ও রাস্তাঘাটে কর্মরত শিশু শ্রমিকের শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাছাড়া শিশু একাডেমি গড়ে তোলা হয়েছে। কচিকাঁচার আসর, ফুলকুঁড়ি, শাপলাশালুক, খেলাঘর, কচি-কণ্ঠ ইত্যাদি অনেক শিশু সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। শিশু, নবারুণ, সবুজ পাতা এসব শিশুপত্রিকা নিয়মিত বের হচ্ছে। তাছাড়া জাতীয় প্রচারমাধ্যমেও বিভিন্ন আঙ্গিকের অনুষ্ঠানমালা প্রচার করা হয়। যেমনঃ অঙ্কুর, নতুন কুঁড়ি ইত্যাদি।
উপসংহার
মহাসমারােহে প্রতিবছর বিশ্ব শিশু দিবস পালিত হয়। কিন্তু বাস্তবে এর প্রয়ােগ কতটুকু? এর জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আর একটি সুষমামণ্ডিত নির্মল পৃথিবী গড়ে তুলতে হবে। আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য। বিশ্ব শিশু দিবসে আমরা যেন সবাই বলতে পারি –
‘প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার’।