‘সেফ ড্রাইভ সেভ লাইফ’ (Safe Drive, Save Life)

“মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে,

মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।”

ভূমিকা:

এই ইচ্ছা বিশ্বকবি কেন, প্রত্যেক মানুষের মনের মধ্যে বিরাজমান। এই শস্য-শ্যামলা বিশাল বিস্তৃত বিপুলা পৃথিবীর প্রতি মায়া-মমতা প্রায় সবার মনেই কম বেশি থাকে। তাই অকালে কোন প্রাণ ঝরে যাক, এমনটা কারো কাম্য নয় । এমনকি পাগলেও তার ভালোটা বোঝে। তাই জেনে শুনে আত্মহননের পথ কেউ বেছে নিতে চায় না । কিন্তু যখন জ্ঞানপাপীর মত কেউ বাস্তব বিপদ জেনেও মাথায় হেলমেট না দিয়ে মোটর বাইক চালায়, বা মদ্যপান করে গাড়ি চালকের আসনে বসে, তখন তার মৃত্যুর কারণ হয় তারই অবিমৃষ্যকারিতা। আর তাদের সাবধান করতেই এই শ্লোগান ‘সেফ ড্রাইভ সেভ লাইফ’।

‘সেফ ড্রাইভ, সেভ লাইফ’ বলতে কি বুঝি?

রাস্তায় বেরোলেই নানা দিক থেকে বিপদ ধেয়ে আসে । সে নিজের ভুলেই হোক, বা অন্যের দোষেই হোক–মৃত্যুকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েই যেন রাস্তায় চলতে হয় ।তৎসত্ত্বেও সকল চালক যদি আত্মসচেতনতার সহিত অন্তত নিজের জীবনকে ভালোবাসে গাড়ি চালায়, তবে পথদুর্ঘটনা অনেক অংশেই কমে যাবে । সব ক্ষেত্রে যে চালকদের দোষে যে দুর্ঘটনা ঘটে তা ঠিক নয়, পথচারীর সচেতনতার অভাবে তা হতে পারে। তবে স্টিয়ারিং যার হাতে থাকে, তাকেই সবচাইতে বেশি সতর্ক হতে হবে । তাই চালকেরা যদি সতর্ক হয়ে গাড়ি চালান তাহলে তার নিজের অমূল্য জীবন যেমন বাঁচবে, তেমনি অনেক নিরাপদ ব্যক্তির জীবন বেঁচে যাবে অকাল মৃত্যুর হাত থেকে । ‘সেফ ড্রাইভ সেভ লাইফ’ কথার অর্থ তাই– নিরাপদে গাড়ি চালাও এবং প্রাণ বাঁচাও।

উদ্যোগ:

পশ্চিমবঙ্গের সবুজসাথী , কন্যাশ্রী প্রকল্পের মত ‘সেফ ড্রাইভ সেভ লাইফ’ প্রকল্প টি কে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বিশেষভাবে সফল করে তুলতে বদ্ধপরিকর। ২০১৬ সালের ৮ ই জুলাই নজরুল মঞ্চে মুখ্যমন্ত্রী তার এইসব সংকল্পের কথা ঘোষণা করেন । তাঁর ইচ্ছানুযায়ী কলকাতা পুলিশ প্রথম এই প্রকল্প শুরু করে এবং বিপুল সাড়া পায়। ‘সেফ ড্রাইভ সেভ লাইফ’ প্রকল্পকে সফল করতে একাধিক পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলা হয়েছে । সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তাঁর নির্দেশিত পদক্ষেপ অনুযায়ী ‘সেফ ড্রাইভ সেভ লাইফ’ এগিয়ে চলছে।

গৃহীত পদক্ষেপ:

রাস্তাঘাটে দুর্ঘটনা যাতে না ঘটে বা কম ঘটে তার জন্য যে পদক্ষেপগুলো নেয়া হয়েছে সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল

  • আরো বেশি করে রাস্তার মোড়ে উঁচুতে সিসিটিভি বসাতে হবে।
  • কলকাতার পাশাপাশি জেলা ও ব্লক স্তরে ও এই কর্মসূচি রূপায়ণ করতে হবে যে ব্লকে আদৌ কোনো দুর্ঘটনা ঘটবে না বা কম দুর্ঘটনা ঘটবে সেই ব্লক কে পুরস্কৃত করা হবে বলেও ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী।
  • কলকাতার পুজো কমিটিগুলোকে সেভ ড্রাইভ সেভ লাইফ পূজার থিম হিসেবে ব্যবহার করতে হবে।
  • সোশ্যাল মিডিয়াতে এই কর্মসূচি জনপ্রিয় করে তোলার পাশাপাশি স্থানীয় ক্লাব লোকশিল্পী রাও সড়ক নিরাপত্তার বিষয়টি প্রচার করবেন।
  • রাস্তার ধারে বড় বড় ব্যানারে সেফ ড্রাইভ সেভ লাইফ স্লোগান লিখে প্রচার করতে হবে।
  • পেট্রল পাম্পগুলি কেও নির্দেশ দেয়া হয়েছে হেলমেট ছাড়া কোন প্রকার পেট্রোল , মোটর বাইক চালক কাউকে দেয়া যাবে না।
  • পুলিশ প্রশাসনকে এ ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

প্রকল্প রূপায়ণ ও বাস্তব পরিস্থিতি:

‘সেফ ড্রাইভ সেভ লাইফ’ উদ্যোগ রাস্তাঘাটে দারুণভাবে সাড়া ফেলেছে। এর ফলে পথদুর্ঘটনা হেলমেট বিহীন বাইক আরোহীর মৃত্যু সংখ্যা অনেক কমে গিয়েছে বলে সরকারি সূত্রে জানানো হয়েছে । গত বছরের জুলাই মাস থেকে এই উদ্যোগ চালু করে কলকাতা পুলিশ। গত বছরের ডিসেম্বরের শেষ পর্যন্ত মোট ৩২ জন হেলমেট হীন বাইক আরোহীর মৃত্যু হয়েছে যা ২০১৫ সালে একই সময়ে ছিল ৬১ জন। এছাড়া ২০১৬ সালে শহরের মোট ১৮৪ টি দুর্ঘটনায় ১৯৫ জনের মৃত্যু হয়েছে, অথচ ২০১৫ সালে ২১৬ টি দুর্ঘটনায় ২২০ জনের মৃত্যুর তুলনায় তা কম।

২০১৬ সালে মোট সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ৪০৭, যা গত পাঁচ বছরের তুলনায় সর্বনিম্ন বলে জানা গিয়েছে । তাছাড়া ২০১৫ সালে যেখানে পথচারীর মৃত্যু সংখ্যা ২১৮ জন ছিল তা ২০১৬ সালে কমে ১৯০ এসে দাঁড়িয়েছে । এ ছাড়া সড়ক দুর্ঘটনায় ২০১৫ সালে আহতের সংখ্যা ছিল ৩০২৯, ২০১৬ সালে বেড়ে ৩১৮২ এসে দাঁড়িয়েছে।

প্রকল্পের ব্যর্থতা:

নিঃসন্দেহে ‘সেফ ড্রাইভ সেভ লাইফ’ একটি সফল প্রকল্প । কিন্তু মানুষের সচেতনতার অভাবে এই উদ্যোগ আজও পূর্ণরূপে সফল হয়নি। আজও রাস্তায় বেরোলে হেলমেট হীন যাত্রী ভুরি ভুরি চোখে পড়ে । মাঝে কলকাতা পুলিশ এক অভিনব উপায়ে হেলমেট যাত্রীদের ঘোড়ার পিঠে চড়িয়ে সচেতনতা ফেরানোর চেষ্টা করেছেন । রাজ্য সরকার পাঠ্যবইয়ের সেভ ড্রাইভ সেভ লাইফ কথাটা ছাপানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

উপসংহার:

সরকারি বা বেসরকারি ক্ষেত্রে উদ্যোগ নিয়ে এই জনকল্যাণমুখী প্রকল্প কে সাফল্যমন্ডিত করতে পারলে আখেরে আমাদেরই লাভ হবে । অকাল মৃত্যুর হাত থেকে যদি আমাদের প্রজন্মকে বাঁচাতে হয় তবে অবশ্যই ‘সেফ ড্রাইভ সেভ লাইফ’ এই শ্লোগানকে আমাদের পথ চলার পথের পাথেয় করে নিতে হবে। পথে আমাদেরই চলতে হবে — কিন্তু সাবধানতার সঙ্গে।

0 thoughts on “‘সেফ ড্রাইভ সেভ লাইফ’ (Safe Drive, Save Life)”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Posts
Scroll to Top