আরও-সত্য (aro satya)

দাদামশায়, সেদিন তুমি যে আরও-সত্যির কথা বলছিলে, সে কি কেবল পরীস্থানেই দেখা যায়।

আমি বললুম, তা নয় গো, এ পৃথিবীতেও তার অভাব নেই। তাকিয়ে দেখলেই হয়। তবে কিনা সেই দেখার চাউনি থাকা চাই।

তা, তুমি দেখতে পাও?

আমার ঐ গুণটাই আছে, যা না দেখবার তাই হঠাৎ দেখে ফেলি। তুমি যখন বসে বসে ভূগোল-বিবরণ মুখস্থ কর তখন মনে পড়ে যায় আমার ভূগোল পড়া। তোমার ঐ ইয়াংসিকিয়াং নদীর কথা পড়লে চোখের সামনে যে জ্যোগ্রাফি খুলে যেত তাকে নিয়ে এক্‌জামিন পাশ করা চলে না। আজও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, সারি সারি উট চলেছে রেশমের বস্তা নিয়ে। একটা উটের পিঠে আমি পেয়েছিলুম জায়গা।

সে কী কথা, দাদামশায়। আমি জানি, তুমি কোনোদিন উটে চড় নি।

ঐ দেখো দিদি, তুমি বড়ো বেশি প্রশ্ন কর।

আচ্ছা, তুমি বলে যাও। তার পরে? উট পেলে তুমি কোথা থেকে।

ঐ দেখো, আবার প্রশ্ন। উট পাই বা না পাই, আমি চ’ড়ে বসি। কোনো দেশে যাই বা না যাই, আমার ভ্রমণ করতে বাধে না। ওটা আমার স্বভাব।

তার পরে কী হল।

তার পরে কত শহর গেলেম পেরিয়ে– ফুচুং, হ্যাংচাও, চুংকুং; কত মরুভূমির ভিতর দিয়ে গিয়েছি রাত্তির বেলায় তারা দেখে রাস্তা চিনে চিনে। গেলুম উস্‌খুস্‌ পাহাড়ের তরাইয়ে। জলপাইয়ের বন দিয়ে, আঙুরের খেত দিয়ে, পাইন গাছের ছায়া দিয়ে। পড়েছিলুম ডাকাতের হাতে, সাদা ভালুক সামনে দাঁড়িয়েছিল দুই থাবা তুলে।

আচ্ছা, এত যে তুমি ঘুরে বেড়ালে, সময় পেলে কখন।

যখন ক্লাশসুদ্ধ ছেলে খাতা নিয়ে পরীক্ষা দিচ্ছিল।

তুমি পরীক্ষায় পাশ করলে তা হলে কী করে।

ওর সহজ উত্তর হচ্ছে– আমি পাশ করি নি।

আচ্ছা, তুমি বলে যাও।

এর কিছুদিন আগে আমি আরব্য উপন্যাসে চীনদেশের রাজকন্যার কথা পড়েছি, বড়ো সুন্দরী তিনি। আশ্চর্যের কথা কী আর বলব, সেই রাজকন্যার সঙ্গেই আমার হল দেখা। সেটা ঘটেছিল ফুচাও নদীর ঘাটে। সাদা পাথর দিয়ে বাঁধানো ঘাট, উপরে নীল পাথরের মণ্ডপ। দুই ধারে দুই চাঁপা গাছ, তার তলায় দুই পাথরের সিংহের মূর্তি। পাশে সোনার ধুনুচি থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছে ধোঁয়া। একজন দাসী পাখা করছিল, একজন চামর দোলাচ্ছিল, একজন দিচ্ছিল চুল বেঁধে। আমি কেমন করে পড়ে গেলুম তাঁর সামনে। রাজকন্যা তখন তাঁর দুধের মতো সাদা ময়ূরকে দাড়িমের দানা খাওয়াচ্ছিলেন, চমকে উঠে বললেন, কে তুমি।

সেই মুহূর্তেই ফস্‌ করে আমার মনে প’ড়ে গেল যে, আমি বাংলাদেশের  রাজপুত্তুর।

সে কী কথা। তুমি তো–

ঐ দেখো, আবার প্রশ্ন? আমি বলছি, সেদিন ছিলুম বাংলাদেশের রাজপুত্তুর, তাই তো বেঁচে গেলুম। নইলে সে তো দূর ক’রে তাড়িয়ে দিত আমাকে। তা না করে দিলে সোনার পেয়ালায় চা খেতে। চন্দ্রমল্লিকার সঙ্গে মেশানো সেই চা, গন্ধে আকুল করে দেয়।

তা হলে কি তোমাকে বিয়ে করল নাকি।

দেখো, ওটা বড়ো গোপন কথা। আজ পর্যন্ত কেউ জানে না।

কুসমি হাততালি দিয়ে বলে উঠল, বিয়ে নিশ্চয়ই হয়েছিল, খুব ঘটা করে হয়েছিল।

–দেখলুম বিয়েটা না হলে ও বড়ো দুঃখিত হবে। শেষকালে হল বিয়ে– হ্যাংচাও শহরের আদ্ধেক রাজত্ব আর শ্রীমতী আংচনী দেবীকে লাভ করলুম। ক’রে–

করে কী হল। আবার বুঝি সেই উটে চড়ে বসলে?

নইলে এখানে ফিরে এসে দাদামশায় হলেম কী করে। হ্যাঁ, চড়েছিলুম– সে উট কোথাও যায় না। মাথার উপর দিয়ে ফুসুং পাখি গান গেয়ে চলে গেল।

ফুসুং পাখি? সে কোথায় থাকে।

কোথাও থাকে না; কিন্তু তার লেজ নীল, তার ডানা বাসন্তী, তার ঘাড়ের কাছে বাদামি, ওরা দলে দলে উড়ে গিয়ে বসল হাচাং গাছে।

হাচাং গাছের তো আমি নাম শুনি নি।

আমিও শুনি নি, তোমাকে বলতে বলতে এইমাত্র মনে পড়ল। আমার ঐ দশা, আমি আগে থাকতে তৈরি হই নে। তখনি তখনি দেখি, তখনি তখনি বলি। আজ আমার ফুসুং পাখি উড়ে চলে গেছে সমুদ্রের আর-এক পারে। অনেকদিন তার কোনো খবর নেই।

কিন্তু, তোমার বিয়ের কী হল। সেই রাজকন্যা?

দেখো, চুপ করে যাও। আমি কোনো জবাব দেব না। আর তা ছাড়া, তুমি দুঃখ কোরো না, তখনও তুমি জন্মাও নি– সে কথা মনে রেখো।

   *

*    *

আমি যখন ছোটো ছিলুম, ছিলুম তখন ছোটো;

আমার ছুটির সঙ্গী ছিল ছবি আঁকার পোটো।

বাড়িটা তার ছিল বুঝি শঙ্খী নদীর মোড়ে,

নাগকন্যা আসত ঘাটে শাঁখের নৌকো চ’ড়ে।

চাঁপার মতো আঙুল দিয়ে বেণীর বাঁধন খুলে

ঘন কালো চুলের গুচ্ছে কী ঢেউ দিত তুলে।

রৌদ্র-আলোয় ঝলক দিয়ে বিন্দুবারির মতো

মাটির ‘পরে পড়ত ঝরে মুক্তা মানিক কত।

নাককেশরের তলায় ব’সে পদ্মফুলের কুঁড়ি

দূরের থেকে কে দিত তার পায়ের তলায় ছুঁড়ি।

একদিন সেই নাগকুমারী ব’লে উঠল, কে ও।

জবাব পেলে, দয়া ক’রে আমার বাড়ি যেয়ো।

রাজপ্রাসাদের দেউড়ি সেথায় শ্বেত পাথরে গাঁথা,

মণ্ডপে তার মুক্তাঝালর দোলায় রাজার ছাতা।

ঘোড়সওয়ারি সৈন্য সেথায় চলে পথে পথে,

রক্তবরন ধ্বজা ওড়ে তিরিশঘোড়ার রথে।

আমি থাকি মালঞ্চেতে রাজবাগানের মালী,

সেইখানেতে যূথীর বনে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালি।

রাজকুমারীর তরে সাজাই কনকচাঁপার ডালা,

বেণীর বাঁধন-তরে গাঁথি শ্বেতকরবীর মালা।

মাধবীতে ধরল কুঁড়ি, আর হবে না দেরি–

তুমি যদি এস তবে ফুটবে তোমায় ঘেরি।

উঠবে জেগে রঙনগুচ্ছ পায়ের আসনটিতে,

সামনে তোমার করবে নৃত্য ময়ূর-ময়ূরীতে।

বনের পথে সারি সারি রজনীগন্ধায়

বাতাস দেবে আকুল ক’রে ফাগুনি সন্ধ্যায়।

বলতে বলতে মাথার উপর উড়ল হাঁসের দল,

নাগকুমারী মুখের ‘পরে টানল নীলাঞ্চল।

ধীরে ধীরে নদীর ‘পরে নামল নীরব পায়ে।

ছায়া হয়ে গেল কখন চাঁপাগাছের ছায়ে।

সন্ধ্যামেঘের সোনার আভা মিলিয়ে গেল জলে।

পাতল রাতি তারা-গাঁথা আসন শূন্যতলে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Posts
Scroll to Top