ভালোমানুষ (bhalo manush)

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ভালোমানুষ : ছিঃ, আমি নেহাত ভালোমানুষ।

কুসমি বললে, কী যে তুমি বল তার ঠিক নেই। তুমি যে ভালোমানুষ সেও কি বলতে হবে। কে না জানে, তুমি ও পাড়ার লোটনগুণ্ডার দলের সর্দার নও। ভালোমানুষ তুমি বল কাকে।

এইবার ঠিক প্রশ্নটা এসেছে তোমার মুখে। ভালোমানুষ তাকেই বলে যে অন্যায়ের কাছেও নিজের দখল ছেড়ে দেয়, দরাজ হাতের গুণে নয়, মনের জোর নেই ব’লেই।

যেমন?

যেমন আজই ঘটেছিল সকালে। বেশ একটুখানি গুছিয়ে নিয়ে লিখতে বসেছিলুম, এমনসময় এসে হাজির পাঁচকড়ি। একেবারে সাহারা থেকে সিমুম হাওয়া বয়ে গেল, শুকিয়ে গেল মনের মধ্যে যা-কিছু ছিল তাজা। ঐ একটি প্রাণী বিধাতার কারখানা থেকে বাঁকা হয়ে বেরিয়েছিল, কোনো মানুষের সঙ্গে কোনোখানেই জোড় মেলে না। এক সময়ে ক্যাল্‌কাটাকে উচ্চারণ করেছিল কালকুট্টা, সেই অবধি সবাই ওকে ডাকত কালোকুত্তা। শুনতে শুনতে সেটা ওর কানে সয়ে গিয়েছিল। ইস্কুলে কেউ ওকে দেখতে পারত না। একদিন আমাদের রমেন ‘রাস্কেল’ ব’লে ঘাড়ের উপর পড়ে ঘুষিয়ে ওর নাক বাঁকিয়ে দিয়েছিল; ব’লে রেখেছিল, এর পরের বারে কান দেবে বাঁকা ক’রে।

এসেই সে বসল আমার লেখাপড়া করার চৌকিটাতে। ভালোমানুষের মুখ দিয়ে বেরোল না, ওখানে আমি কাজ করব। ডেস্কের উপর ঝুঁকে যেন অন্যমনে এটা ওটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগল। বললে দোষ হত না যে, ওগুলো দরকারি জিনিস, ঘাঁটাঘাঁটি কোরো না। কিন্তু– কী আর বলব। বললে, অনেককাল দেখা সাক্ষাৎ হয় নি। শুরু করলে, আহা আমাদের সেই ইস্কুলের দিন ছিল কী সুখের। গল্প লাগালে খোঁড়া গোবিন্দ ময়রার। দেখি, আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে আমার সোনা-বাঁধানো ফাউন্টেন-পেনটা, চাদরের আড়ালে ওর পকেটের দিকে। বললেই হত, ভুল করছ, কলমটা তোমার নয়, ওটা আমার। কিন্তু, আমি যে ভালোমানুষ, ভদ্রলোকের ছেলে– এতবড়ো লজ্জার কথা ওকে বলি কী ক’রে। ওর চুরিকরা হাতটার দিকে চাইতেই পারলুম না। সন্দেহ করছি লোকটা ব’লে বসবে, আজ এখানেই খাব। বলতে পারব না, না, সে হবে না। ভাবতে ভাবতে ঘেমে উঠেছি। হঠাৎ মাথায় বুদ্ধি এল; ব’লে বসলুম, রমেনের ওখানে আমাকে এখনি যেতে হবে।

কালকুত্তা বললে, ভালো হল, তোমার সঙ্গে একত্রেই যাওয়া যাক। ইস্কুল ছেড়ে অবধি তার সঙ্গে একবারও দেখা হয় নি।

কী মুশকিল। ধপ্‌ করে বসে পড়লুম। বাইরের দিকে তাকিয়ে বললুম, বৃষ্টি পড়ছে দেখছি।

ও বললে, তাতে হয়েছে কী। আমার ছাতা নেই, কিন্তু তোমার সঙ্গে এক ছাতাতেই যেতে পারব।

আর কেউ হলে জোর করেই বলত, সে হবে না। কিন্তু, আমার উপায় নেই। তা, ভালোমানুষ হলেও বিপদে পড়লে আমার মাথাতেও বুদ্ধি জোগায়। আমি বললুম, অত অসুবিধা করবার দরকার কী। তার চেয়ে বরঞ্চ ছাতাটা তুমি নিয়ে যাও, যখনি সুযোগ হবে ফিরিয়ে দিলেই হবে।

আর সে তিলমাত্র দেরি করল না। বললে, প্ল্যানটা শোনাচ্ছে ভালো।

ছাতাটা বগলে ক’রে চট্‌পট্‌ সরে পড়ল। ভয় ছিল, ফাউন্টেন-পেনের খোঁজ উঠে পড়ে। ছাতা ফেরাবার সুযোগ কোনোদিনই হবে না। হায় রে, আমার পনেরো টাকা দামের সিল্কের ছাতাটা। ছাতা ফিরবে না, ফাউন্টেন-পেনও ফিরবে না, কিন্তু সবচেয়ে আরামের কথা হচ্ছে– সেও ফিরবে না।

কী বল, দাদামশায়! তোমার সেই ফাউন্টেন-পেন, সেই ছাতা, তুমি ফিরে পাবে না?

ভদ্র বিধান-মতে ফিরে পাবার আশা নেই।

আর, অভদ্র বিধান-মতে?

ভালোমানুষের কুষ্ঠিতে সে লেখে না।

আমি তো ভালোমানুষ নই, আমি তাকে চিঠি লিখব– তোমার সে কথা জানবার দরকার হবে না।

আরে ছিছি, না না, সে কি হয়। আর, লিখে হবেই বা কী। সে বলবে আমি নিই নি।

জানি, ও তাই বলবে। কিন্তু, আমরা যে জেনেছি ও চুরি করেছে, সেইটেই ওকে আমি জানাতে চাই।

সর্বনাশ! ঠিক সেইটেই ওকে জানাতে চাই নে– ভদ্রলোকের ছেলে চুরি করেছে– ছিছি, কতবড়ো লজ্জার কথা। আমার এমন কত গেছে, তুমি তখন জন্মাও নি। তখন ব্রাউনিঙের কবিতার আদর নতুন বেড়েছে। খুব আগ্রহ করে পড়ছিলুম। আমার সাহিত্যিক বন্ধুকে উৎসাহ করে একটা কবিতা পড়ে শোনালুম। তিনি বললেন, এ বইটা আমার নিশ্চয় পড়া চাই, তিন দিন পরেই ফিরিয়ে দেব। আমার মুখ শুকিয়ে গেল। বললুম, এটা আমি এখন পড়ছি। এতই ভালোমানুষের সুরে বলেছিলুম যে বইটা রাখতে পারা গেল না। দিনকয়েক পরে খবর নিয়ে জানলুম, তিনি গেছেন একটা মকদ্দমার তদ্‌বির করতে বহরমপুরে। ফিরতে দেরি হবে। আমার জানা হকারকে ব’লে দিলুম, ব্রাউনিঙের বড়ো এডিশনটা যদি পাওয়া যায় আমাকে যেন জানায়। কিছুদিন পরে খবর পেলাম, পাওয়া গেছে। বইটা বের করে দেখালে, আমারই সেই বই। যে পাতাখানায় আমার নাম লেখা ছিল সেই পাতাটা ছেঁড়া। কিনে নিলুম। তার পর থেকে সেই বইখানা লুকিয়ে রাখতে হল, যেন আমিই চোর। আমার লাইব্রেরি ঘাঁটতে ঘাঁটতে পাছে বইখানা তাঁর হাতে ঠেকে। আমার কাছে তাঁর বিদ্যে ধরা পড়েছে, এ কথাটা পাছে তিনি জানতে পান। আহা, হাজার হোক, ভদ্রলোক।

আর বলতে হবে না, দাদামশায়, পষ্ট বুঝেছি কাকে বলে ভালোমানুষ।

   *

*    *

মণিরাম সত্যই স্যায়না,

বাহিরের ধাক্কা সে নেয় না।

বেশি ক’রে আপনারে দেখাতে

চায় যেন কোনোমতে ঠেকাতে।

যোগ্যতা থাকে যদি থাক্‌-না,

ঢাকে তারে চাপা দিয়ে ঢাকনা।

আপনারে ঠেলে রেখে কোণেতে

তবে সে আরাম পায় মনেতে।

যেথা তারে নিতে চায় আগিয়ে

দূরে থাকে সে সভায় না গিয়ে।

বলে না সে, আরো দে বা খুবই দে;

ঠেলা নাহি মারে পেলে সুবিধে।

যদি দেখে টানাটানি খাবারে

বলে, কী যে পেট ভার, বাবা রে।

ব্যঞ্জনে নুন নেই, খাবে তা;

মুখ দেখে বোঝা নাহি যাবে তা।

যদি শোনে, যা তা বলে লোকরা

বলে, আহা, ওরা ছেলে-ছোকরা।

পাঁচু বই নিয়ে গেল না ব’লে;

বলে, খোঁটা দিয়ো নাকো তা ব’লে।

বন্ধু ঠকায় যদি, সইবে;

বলে, হিসাবের ভুল দৈবে।

ধার নিয়ে যার কোনো সাড়া নেই

বলে তারে, বিশেষ তো তাড়া নেই।

যত কেন যায় তারে ঘা মারি

বলে, দোষ ছিল বুঝি আমারি।

x

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
Related Posts
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x
Scroll to Top