নগরজীবনের কুশ্রীতা ও তার দূরীকরণের উপায় ( The Ugliness of City Life and the Way to Eliminate it)

ভূমিকা

ইট কাঠ পাথরে গড়া অট্টালিকার মিছিলে যেকোনো আধুনিক নগর সৌধ কারাগার। সেখানে আকাশ প্রায় অদৃশ্য, সূর্যালোক ক্বচিৎ দৃশ্যমান, বায়ুপ্রবাহ বড় বেশি কুণ্ঠিত। নগর জীবনে সুখ স্বাচ্ছন্দ, আরাম-আয়েশ, বিলাসব্যসন, অর্থ বৈভব যতই থাক, আর ওই আকর্ষনে মানুষ দলে দলে যতই ভীড় জমাক, পাষাণ করার কৃত্রিম পরিবেশে দু চার দিন যেতে না যেতেই হাঁপিয়ে ওঠে প্রাণ। নব সভ্যতার কাছে তাই বিশ্বকবির সখেদে প্রার্থনা :

‘দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর, ‘লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ট ও প্রস্তর’ ।

নগর জীবনের সূচনা ও ক্রমবিকাশ

নগর জীবনের সূচনা ইতিহাসের সেই যুগে প্রজার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে রাজা যখন বসেন সিংহাসনে। তার রাজালয়কে ঘিরে যে অভিজাত জনপদের উদ্ভব, তাতেই নগর সভ্যতার উন্মেষ। রোম ,এথেন্স, স্পার্টা, অযোধ্যা ,পাঞ্চাল, বিদর্ভ ইতিহাসে এমন প্রাচীন নগর নগরীর কত নামই না আছে। কালক্রমে কবির পাশাপাশি শিল্পের হয়েছে বিকাশ, আর এই দুই সম্পদের বিনিময় কেন্দ্রগুলি ধীরে ধীরে নগর বন্দরের গৌরবে হয়েছে উন্নীত। বাষ্প শক্তি আবিষ্কারের ফলে ইউরোপ ভূখণ্ডে অষ্টাদশ শতাব্দীতে সংঘটিত হয় শিল্প বিপ্লব। তার জোয়ার উত্তাল হয়ে আছড়ে পড়ে দেশ-দেশান্তরে। বড় বড় কল কারখানা তৈরি হয়। বড় বল শিল্পের কেন্দ্রীভবনের ফলে সারাবিশ্বে জন্ম নেয় অসংখ্য শিল্পনগরী। এমনকি প্রাচীন নগর নগরির সঙ্গে যুক্ত হয় ছোট কিংবা বড় যেকোনো শিল্প প্রতিষ্ঠান। কিভাবে যন্ত্র সমৃদ্ধ আধুনিকতার প্রভাবে নগর জীবনে দ্রুত পালাবদল ঘটতে থাকে।

কুশ্রীতার চিত্র

ভোগ সুখের বস্তু ভারে পৃষ্ঠ মানুষ দ্রুত হারিয়েছে দয়ামায়া, সৌন্দর্য চেতনা আর মানবিক মূল্যবোধকে। তার আচার-আচরণে, চিন্তা মননে অবক্ষয়ের দগদগে ক্ষত চিহ্ন। একদিকে লোভ স্বার্থপরতা, আর একদিকে মানুষের প্রতি মানুষের যে স্বাভাবিক দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ তার একান্ত অস্বাস্থ্যকর স্বস্তি, অট্টালিকার ভিতর রাজভোগ এর অপচয় আর তারই অদুরে রাস্তার আবর্জনা স্তুপে খাদ্যের সন্ধানে উদ্ভ্রান্ত ক্ষুদার্থ ভিখারি। এই অসঙ্গত বিষম দৃশ্য অতিশয় দৃষ্টিকটু। কদর্য কুশ্রীতার চিত্র ছড়িয়ে আছে নগরজীবনের অন্যত্রও। নর্দমার দুর্গন্ধ জলে ও আবর্জনায় অনেক পথঘাট, স্বস্তি অঞ্চল যেন নরককুণ্ড। যত্রতত্র আবর্জনা স্তুপ। ধুলা ধোঁয়াশায় শ্বাসরোধের উপক্রম।

সূর্যালোক, বিশুদ্ধ জল ও বাতাসের অভাব নানা ব্যাধির সংক্রমণের পথকে করে প্রশস্ত । পথের দুধারে মল মুত্রের ছড়াছড়ি বিকৃত রুচির পরিচয় দেয়। ফুটপাতের ওপর জবরদখল মালিকানা নিয়ে পণ্য পসরা সাজিয়ে বসা কিংবা গৃহস্থালি পেতে জীবন নির্বাহ করা এক ধরনের সংকীর্ণ মানসিকতা। রাজনৈতিক স্লোগানের মসি পেলনে কিংবা বিজ্ঞাপনের প্রচারপত্র লাগিয়ে নগর দেহের শোভা বিকৃত করা সৌন্দর্যবোধ হীনতার পরিচায়ক। পথের পার্কে মহামনীষীদের প্রতিমূর্তি ভাঙা কিংবা কালিমালিপ্ত করা অসুস্থ মানসিকতার দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করে।

কুশ্রীতার কারণ

প্রশ্ন হলো নগরজীবন দিনে দিনে কুশ্রীতার শিকার হয়ে পড়ছে কেন ?

  • এক : ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যানবাহন ,রুজি রোজগার, থাকা-খাওয়ার সংস্থান হচ্ছে না। ফলে আশাভঙ্গের বেদনায় জমছে জনরোধ।
  • দুই : শ্রমিক-মালিক, ধনী গরিবের বৈষম্য সংঘাত- সংঘর্ষ ও অশান্তির সৃষ্টি করছে।
  • তিন : বেকারত্বের অভিশাপ জীবনের প্রতি আস্থাহীনতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে হৃদয়জ কোমল ভিত্তি গুলি হারিয়ে ফেলে যুবশক্তি অন্ধ তামসী কথার দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে।
  • চার :- নাগরিক দায়িত্বহীনতা ও সুস্থ নগরজীবনের বোধ বুদ্ধি সচেতনতার অভাব নগর জীবনে কুশ্রীতাকে করেছে ত্বরান্বিত।
  • পাঁচ :- রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তি কায়েমের প্রতিযোগিতা ও সুস্থ জীবনাচরণকে করছে ব্যাহত।
  • ছয় :- সরকারও পৌরসংস্থার ভ্রান্ত নীতি, ঔদাসীন্য, ও সংকীর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধি এবং উপেক্ষা বঞ্চনা ও অনেকাংশে দায়ী।

কুশ্রীতা দূরীকরণের ভাবনা ও উপায়

কিছু কিছু আধুনিক নগর সুপরিকল্পিত ভাবে গড়ে উঠছে। সৌন্দর্যবর্ধন ও স্বাস্থ্যকর জীবনাচরণের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা হচ্ছে। কিন্তু এদের সংখ্যা নিতান্ত অঙ্গুলী গণ্য। অধিকাংশ নগর নগরীর কদর্য কুশ্রীতার ভয়াবহতা কল্যাণকামী মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে । সমস্যা সমাধানের ভাবনায় তারা উদভ্রান্ত। কুশ্রীতা দূরীকরণের কাজে হাত লাগাতে হবে সরকারও পৌরসংস্থার সঙ্গে প্রতিটি নগরবাসীকে। শিক্ষা, নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের উদ্বোধন, পারস্পরিক সহমর্মিতা, সৌন্দর্য সচেতনতা, নগর পরিবেশকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার আন্তরিক ও সক্রিয় প্রচেষ্টা, কর্তৃপক্ষের নিয়মিত নজরদারি এগুলি অত্যন্ত জরুরী। উন্নত জীবনবোধ, পরিশীলিত মন ও মনন, উচ্চ জীবনাদর্শ সুস্থ নগর জীবন সুরক্ষার অপরিহার্য শর্ত। এসবের জন্য সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে সরকার, পৌর সংস্থা, রাজনৈতিক দল এবং খবরের কাগজ বেতার দূরদর্শন প্রভৃতি গণমাধ্যমকে।

উপসংহার

সর্বোপরি মনে রাখতে হবে দারিদ্র, অশিক্ষা ও বেকারত্বের রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত হতে না পারলে সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হবে। সুস্থ-সুন্দর সুরুচিসম্পন্ন নগর জীবনের স্বপ্নকে না দেখে ? কে চায় কদর্য কুশ্রীতার পক্ষে নিমজ্জিত হয়ে নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে ? আসলে বোধবুদ্ধি দায়িত্ব কর্তব্য এগুলির অভাবই তো ঠেলে দিচ্ছে তামসিকতার গর্ভে। এগুলির উদ্বোধনের দায়িত্ব যাদের উপর বর্তায় তাদের শুভবোধের জাগরণী কুশ্রীতা থেকে মুক্তির পথ – পরিত্রাণের উপায়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Posts
Scroll to Top