প্রাত্যহিক জীবনে বিদ্যুৎ (Electricity in daily life)

ভূমিকা

বই হাতে জীবনানন্দের মুগ্ধতা আমার শরীরে,ক্রমে দুপুর গড়িয়ে বিকেল। সন্ধ্যে হয়ে আসছে। ঘরের আরো অস্পষ্ট হয়ে আসছে। অথচ আমি তখন জীবনানন্দের অবলম্বনে জীবনের করুণ ট্রাজেডিতে অভিভূত। তখন সে বলছে–‘ আমি বাঁচতে চাই, আমি ছেলেপুলে চাই, সংসার চাই’ – এমন সময় মোমবাতি খোঁজা কিংবা হারিকেন লন্ঠন জ্বালানো কী বিরক্তিকর, ভাবা যায়। কিন্তু না, আমি আমার টেবিলের ওপর রাখা সুইচটা টিপে দিলাম। মুহূর্তের মধ্যে ঘরটা আলোয় ঝলমল করে উঠল। আমি আবার জীবনানন্দের বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজলাম‍। এই যে আলোর ঝলক, যা মুহূর্তের মধ্যে আমার সমস্যার সমাধান করে দিল তার নাম বিদ্যুৎ। আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আজ বিদ্যুৎ আমাদের সঙ্গী। অকৃত্রিম বন্ধু। বিদ্যুৎ ছাড়া আধুনিক জীবনযাত্রা আমরা কল্পনাও করতে পারি না।

আধুনিক জীবনে বিদ্যুৎ

বিদ্যুৎ বিজ্ঞানের এক আশ্চর্য আবিষ্কার। একবিংশ শতাব্দীর এই বিজ্ঞান নির্ভর যুগে নিত্য-নৈমিত্তিক প্রয়োজনে বিদ্যুৎকে আমরা অনুগত ভৃত‍্যের মতো ব্যবহার করি। বিদ্যুৎ আজ আমাদের কাছে সোনার কাঠির স্পর্শের মতো। কি কারখানায়, কি কৃষিকাজে, কি চিকিৎসার ক্ষেত্রে সর্বত্রই বিদ্যুতের অকৃত্রিম উদার হস্ত প্রসারিত। বিদ্যুতের সাহায্যে কল-কারখানা চলে, বৃদ্ধি হয় উৎপাদন, বৃদ্ধি হয় জাতীয় সম্পদ। কৃষিক্ষেত্রে বিদ্যুতের সাহায্যে গভীর নলকূপ থেকে জলসেচ করে সবুজ বিপ্লবের সূচনা হয়েছে। গ্রামের তাঁতিরা যন্ত্রচালিত তাঁতের সাহায্যে উৎকৃষ্ট ধরনের কাপড় উৎপাদন করছে। চলছে কলকারখানা। এক কথায় বলতে গেলে বিদ্যুৎ হল প্রগতির প্রাণশক্তি।

সংবাদ, সংযোগ ও সম্প্রচারে বিদ্যুৎ

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বিদ্যুতের প্রভাব অপরিসীম। সকালে সারা পৃথিবীর সংবাদ বহন করে একটি সংবাদপত্র যখন আমাদের হাতে পৌঁছায়, তখন আমরা কি ভাবতে পারি, এত অল্প সময়ে এত বড় সংবাদপত্রটি ছাপা হয়ে আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে। কেবলমাত্র বিদ্যুৎচালিত মুদ্রণ যন্ত্রে এটি মুদ্রিত হয়েছে বলেই তা সম্ভব হয়েছে। বিদ্যুৎ আজ সমগ্র পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মধ্যে দূরত্বকে সংকুচিত করেছে। দূরকে করেছে নিকট। পৃথিবীর যে কোনো স্থানের খবর আমরা মুহূর্তের মধ্যে পেতে পারি। টেলিগ্রাম, টেলিপ্রিন্টার, টেলিফোনের মাধ্যমে দূর-দূরান্তের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারি। এগুলির সাহায্যে ব্যবসায়ী দেশ-বিদেশে ছড়ানো তাঁর ব্যবসার খবর জানতে পারেন, স্বদেশে বা বিদেশে অবস্থিত লোকেরা নিজেদের আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।

আবাসিক জীবনের বিদ্যুৎ

দশ- বারো তলা বাড়িতে উঠবার জন্য এখন আর একের পর এক সিঁড়ি ভাঙার প্রয়োজন হয় না। সেখানে উঠবার জন্য বিদ্যুৎ চালিত ‘লিফট’-এ উঠে দাঁড়ালে তা ক্ষণিকের মধ্যে আমাদের ইপ্সিত স্থানে পৌঁছে দেবে। ঐসব বহুতল বাড়িতে জল তোলার জন্য বিদ্যুৎ চালিত পাম্প বসানোর রয়েছে। একদিন বিদ্যুৎ না থাকলে সেইসব প্রাসাদ বাসীর কষ্টের সীমা থাকে না। বিদ্যুতের অসীম কৃপায় আজকাল আর কয়লার উনুনের প্রয়োজন হয়না। অতি অল্প সময়ে রান্নাবান্নার জন্য ইলেকট্রিক হিটার,স্টোভ,কুকার আমাদের সাহায্য করে। এতে একদিকে যেমন সময় বাঁচে, অন্যদিকে তেমনি কয়লার ধোঁয়া আর কয়লার কালির হাত থেকে বাচা যায়। বিদ্যুৎ চালিত যন্ত্রের সাহায্যে কাপড় কাচা যায়, ভ্যাকুয়াম পাম্প এর সাহায্যে ঘর পরিষ্কার করা সম্ভব হয়, বর্তমান দুর্মূল্যের বাজারে মাছ, মাংস, শাক- সবজি যাতে নষ্ট না হয় সে জন্য সৃষ্টি হয়েছে রেফ্রিজারেটারের। সারাদিনের ক্লান্তিতে মন যখন অবসন্ন হয়ে আসে, কাজে আর যখন মন বসতে চায় না তখন রেডিও খুলে দিলে কিংবা সি.ডি অথবা ডি.ভি.ডি-তে ক্যাসেট পুরে দিলে সুরের ঝংকার আর সংগীতের লহরীতে মন আনন্দে মেতে ওঠে। তৎক্ষণাৎ মনের ক্লান্তি এবং অবসাদ দূর হয়। আবার টেলিভিশনের সাহায্যে ঘরের কোণে বসে পৃথিবীর যেকোন প্রান্তের অনুষ্ঠান শুনে ও প্রত্যক্ষ করে মনের ভার লাঘব করতে পারা যায়।

চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিদ্যুৎ

রোগাক্রান্ত মানুষকেও বিদ্যুৎ আশার আলো দেখিয়েছে। রঞ্জন রশ্মির সাহায্যে চিকিৎসকেরা এখন নিখুঁতভাবে দেহের ভিতর দেহের অভ্যন্তরের রোগ নির্ণয় করে যথোপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানে ‘Electro therapy’ নামে বৈদ্যুতিক চিকিৎসার একটি শাখা রয়েছে। রেডিয়াম রশ্মি,বেগুনি রশ্মি বিভিন্ন ধরনের রোগ জীবাণু ধ্বংস করে আমাদের রোগ নিরাময়ের সাহায্য করে ।

পরিবহনে বিদ্যুৎ

পরিবহন ব্যবস্থা তে ও বিদ্যুতের দান অনস্বীকার্য। বৈদ‍্যুতিক ট্রেনে করে দূরদূরান্তের গ্রামের মানুষ প্রতিদিন শহরে এসে অফিস করতে পারে, নিজেদের কাজকর্ম সেরে আবার ফিরে যেতে পারে। কারণ ইলেকট্রিক ইঞ্জিন চালিত ট্রেন বাষ্প চালিত ইঞ্জিনের ট্রেনের চেয়ে দ্রুতগতি সম্পন্ন। তাছাড়া শহর কলকাতায় ট্রাম চলে বিদ্যুতের সাহায্যে। বড় বড় জাহাজে মাল ওঠানো-নামানো হয় বিদ্যুৎ চালিত ক্রেনের সাহায্যে।

উপসংহার

জন্ম থেকে আরম্ভ করে মৃত্যু পর্যন্ত বিদ্যুৎ আমাদের নিত্য সহচর। এমনকি ঘুমন্ত অবস্থায়ও বিদ্যুতিক পাখা, এয়ার কুলার ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র আমাদের শরীর শীতল করে। আবার মৃত্যুর পর বৈদ্যুতিক চুল্লি তে আমাদের দেহ ভস্মীভূত হয়। সুতরাং বিদ্যুৎ আমাদের নিত্যসঙ্গী। বিদ্যুতের এই ব্যাপক চাহিদা মেটানোর জন্যে বিভিন্ন খরস্রোতা নদী গুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের বৃহৎ প্রচেষ্টা আজ স্বার্থক হয়েছে। তবে বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ সহ গোটা দেশ ভয়াবহ বিদ্যুৎ সংকটের সম্মুখীন। কয়লার সমস্যা যার অন্যতম কারণ। সেজন্য কয়লার মতো সীমাবদ্ধ ভান্ডারকে দুর্দিনের জন্য সঞ্চিত রেখে বিদ্যুৎ বাঁচানোর দিকেই মনোনিবেশ করা উচিত। কারণ দেশে এখনো ভয়ঙ্কর বিদ্যুৎ সঙ্কট চলছে। এই সমস্যার সমাধানে নতুন নতুন বিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ে তোলার সরকারি উদ্যোগ ও আশু প্রয়োজন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Posts
Scroll to Top