ভূমিকা:
নদীমাতৃক বঙ্গভূমিতে বন্যা পরিচিত প্রাকৃতিক ঘটনা ।বাঙালি জীবনের যেন সহযাত্রী। তা সত্বেও ১০-১২বছর অন্তর বন্যা এমন বিধ্বংসী ও সর্বগ্রাসী চেহারা নিয়ে বঙ্গভূমিতে এমন হানা দেয়, এই মহাপ্লাবন বিশাল জনপদকে ধুয়েমুছে সাফ করে ইতিহাস হয়ে যায়। বাঙালির স্মৃতিতে দুঃস্বপ্নের মতো বিরাজ করে। ১৯৭৮- এ পশ্চিমবঙ্গের দশটি জেলায় ভয়াবহ বন্যার দুঃস্বপ্ন ভরা স্মৃতি বাঙালি আজ ও ভোলেনি। তার প্রায় দশ বছর অন্তর আটের ও নয়ের দশকের শেষদিকে বন্যার মহাতান্ডব চলে উত্তর-মধ্য ও দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলায়। নতুন সহস্রাব্দে ফের পশ্চিমবঙ্গের আটটি জেলায় বিধ্বংসী মহাপ্লাবনের ঘটনা সৃষ্টি করে নতুন ইতিহাস।
বন্যার সূচনা ও বিস্তার:
১৯ সেপ্টেম্বর ২০০০ বিহার মালভূমিতে সৃষ্ট নিম্নচাপের প্রভাবে বিহার পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূমসহ দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলিতে প্রবল বর্ষণ শুরু হয়। চব্বিশ ঘন্টায় বীরভূমে বৃষ্টি হয় ২৭৭ মিমি. পুরুলিয়ায় ১১৯ মিমি.ও বাঁকুড়ায় ১৫৮ মিমি.। অবিরাম প্রবল বর্ষণে বীরভূম, বর্ধমান ও মুর্শিদাবাদের বহু এলাকা প্লাবিত হয়। মেদিনীপুর জেলার কিছু অঞ্চলসহ হাওড়া, হুগলি ,নদীয়া ,উত্তর চব্বিশ পরগনার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জলের তলে নিমজ্জিত হয়। বর্ষণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নেমে আসে তিলপাড়া, ম্যাসাঞ্জোর জলাধার থেকে ছাড়া উত্তাল জলধারা। দ্বারকা, ময়ূরাক্ষী, জয় ,ব্রাহ্মণী, ভাগীরথীতে অস্বাভাবিক জলস্ফীতি ঘটে। নদী -বাঁধ ভেঙে কিংবা নদী -বাঁধ উপচে প্লাবন অসংখ্য গ্রাম,গঞ্জে ও শহর গ্রাস করে। দামোদরের বাঁধ গুলি থেকেও জল ছাড়ার ফলে প্লাবন সর্বগ্রাসী হয়ে ওঠে। কলকাতা মহানগরীর নিম্নাঞ্চল অতিবর্ষণে ও হুগলি নদীর জোয়ারের জলে প্লাবিত হয়।
দুঃখ-কষ্ট -দুর্গতি, ব্যাধির প্রকোপ ও প্রাণহানি :
এই মহাপ্লাবনের সহস্রাধিক মানুষের জীবনহানি ঘটে। শত শত মানুষ জল স্রোতে ভেসে গিয়ে নিখোঁজ হয়। এক কোটি আশি লক্ষ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয় ।কত যে গবাদিপশু মারা যায় তার হিসেব নেই। বন্যা দুর্গত মানুষের দুঃখ কষ্টের অবধি ছিল না। মাঠের ফসল বিনষ্ট হয়। মানুষ থাকার আশ্রয় হারায়। সঞ্চিত খাদ্য সামগ্রী ভেসে যায়। খাদ্য ও পানীয় জলের অভাবে অনেকে প্রাণ হারাতে হয়। উদ্ধার ও ত্রাণের কাজ যথাসময়ে যথাযথভাবে না হলে দুঃখ কষ্টের ভার আরো বাড়ে। সর্প দংশনে বেশকিছু লোক মারা যায়। আন্ত্রিক মহামারির আকার ধারণ করাতে মৃত্যুর হার লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে।
বন্যার কারণ:
এই মহাপ্লাবনের কারণ বহুবিধ
- (১) একনাগাড়ে অস্বাভাবিক অতিবর্ষণ।
- (২) জলাধার গুলি থেকে একই সময়ে মাত্রাতিরিক্ত জল ছাড়া।
- (৩) নিকাশি ব্যবস্থার অপ্রতুলতা।
- (৪) ভরে যাওয়া ও মজে যাওয়া নদীগর্ভ খাল-নালা প্রভৃতি জল নিকাশের অন্তরায়।
- (৫)নদী পরিকল্পনায় নদী উৎস মুখেই কেবল বাঁধ ও জলাধার নির্মিত হয়েছে। নদীর মধ্য ও নিম্নাংশে বন্যা রোধের জন্য কোন রকম ব্যবস্থা নেই।
- (৬) নদীর মধ্য ও নিম্নাংশে ড্রেজিং এর ব্যবস্থা না থাকায় জলপ্রবাহের বিঘ্ন।
- (৭) পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ নদীর উৎস স্থল হলো বিহার ও পুরুলিয়া অঞ্চলে বিস্তীর্ণ মালভূমি। ওই অঞ্চলে অতিবর্ষণ হলে দক্ষিণবঙ্গে ভয়াবহ বন্যা হয়।
প্রতিকারের ভাবনা:
মহাপ্লাবনের মহাগ্ৰাস থেকে বাঁচার জন্য মানুষ প্রতিকারের উপায় ভাবতে বাধ্য হয়েছে। প্রতিকারের উপায় দুভাবে দেখা যেতে পারে। এক– বন্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা। সম্ভব হলে নদীর উৎস মুখে নিয়ন্ত্রণে বাঁধন গড়ে তোলা। আর তা না হলে নদীতীরে পাকাপোক্ত শক্ত নিগড় গড়া যাতে বাঁধ ভেঙে বা বাঁধ টপকে নদী গ্রামে-গঞ্জে- শহরে হানা দিতে না পারে। বাঁধ গুলিকে যথাযথ মেরামত করে শক্ত করে রাখা। অবহেলায় গাফিলতিতে কিংবা দুর্নীতির চোরাবালিতে সেগুলো যাতে জীর্ন না হয়ে পড়ে সেদিকে দৃষ্টি রাখা। দুই– বানভাসি অবস্থার অশনি সংকেত দেখা দিলেই আগাম হুঁশিয়ারি দিয়ে উদ্ধার ও ত্রাণ এর কাজে যথাসময়ে যথাযথভাবে ঝাঁপিয়ে পড়া। সবকয়টি আশ্রয়হীন মানুষকে ত্রাণশিবিরে রেখে খাদ্য-পানীয় প্রয়োজনীয় ওষুধের ব্যবস্থা করা। সংক্রমণ ব্যাধি যাতে ছড়িয়ে না পড়ে সেজন্য প্রতিষেধকের ব্যবস্থা করা।
উপসংহার:
বন্যা দুর্গত মানুষের সেবায় উদ্ধারের বহু স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠা অতি নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে থাকেন। তাদের এই মানব কল্যাণকর প্রয়াস ও প্রচেষ্টা প্রশংসার্হ। সরকারের দায়িত্ব সবার উপরে। সেখানে অবহেলা, গাফিলতি কিংবা রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব অবশ্যই নিন্দনীয়। দুঃখের বিষয়, প্রায়শ ও সেরকম অভিযোগের আঙুল উঠতে দেখা যায়। যাই হোক, সরকার তো জনগণকে নিয়েই। বিপদের সময় সবরকম ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে থেকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সরকারের সঙ্গে পূর্ণ সহযোগিতা করে যাতে একটি প্রাণ অকালে না ঝরে যায় সেদিকে লক্ষ্য রেখে আর্ত মানুষের উদ্ধারেও ত্রাণে নিজেদের উৎসর্গ করতে পারলে, তার চেয়ে বড় আর কিছু হতে পারে না।