কলকাতার পাতাল রেল (Kolkata Metro)

ভূমিকা

কলকাতা , সুতানটি ও গোবিন্দপুর নিয়ে কলকাতা মহানগরীর পতন হয়েছিল জব চাণক্যের প্রচেষ্টায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন কালে। কলকাতা ইংরেজি বণিকদের ব্যবসা-বাণিজ্যের কেবল কেন্দ্রস্থলই ছিলনা, একসময় ব্রিটিশ শাসিত সংযুক্ত ভারত ব্রম্ভ দেশের রাজধানী ছিল। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী। কলকাতা হুগলি নদীর মোহনায় অবস্থিত পূর্ব ভারতের বৃহত্তম বন্দর। রাজকার্যে, ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রয়োজনে, রুজি-রোজগারের তাগিদে, অধ্যায়নাদির উদ্দেশ্যে গ্রামবাংলা তো বটেই, ভারতের নানা প্রান্ত থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড় জমেছে কলকাতা শহরে। বর্তমানে কলকাতা ভারতের বৃহত্তম জনবহুল নগর।

পরিবহন-সমস্যার কারণ ও যানবাহনের বৈচিত্র

জনসংখ্যা বৃদ্ধি কলকাতা মহানগরীর পরিবহন সমস্যার প্রধানতম কারণ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল রেখে কলকাতার যানবাহনের সংখ্যা যথেষ্ট বেড়েছে। যাত্রী বহনের জন্য আছে বাস,ট্রাম,ট্যাক্সি, মিনিবাস, রিক্সা ,ঘোড়ার গাড়ি প্রভৃতি ।মালপত্রাদি পরিবহনের জন্য লরি ,ট্রাক,টেম্পো, গরুর গাড়ি ,মানুষের টানা ঠেলাগাড়ি প্রভৃতি। অথচ এককালে পুরনো কলকাতায় ছিল এককা গাড়ি, ছ‍্যাকরা গাড়ি– যান্ত্রিক যানের চিহ্নমাত্র ছিলনা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায় –‘না ছিল ট্রাম,না ছিল বাস, না ছিল মোটরগাড়ি’। কলকাতা শহরে দিনবদলের পালায় মানুষের সমাগম বাড়ল, রাজপথ পিচ মোড়া হল, এল যান্ত্রিক শকট– ১৮৮১-তে মোটরগাড়ি, ১৯০২-এ ট্রাম, ১৯২২- এ প্রাইভেট বাস ও স্বাধীনোত্তর ১৯৪৮-এ স্টেট বাস। শিয়ালদহ ও হাওড়া স্টেশন থেকে দ্রুতগামী ইলেকট্রিক ট্রেন শহরতলী অঞ্চলে চলছে, বিভিন্ন লোকালয় ও শহর গুলি থেকে স্টেট বাস ও প্রাইভেট বাস মহানগরীর মধ্যে যাওয়া-আসা করছে। গঙ্গার বুকে চলছে লঞ্চ সার্ভিস। চলছে চক্ররেল, পাতাল রেল। তা সত্বেও কলকাতার পরিবহন সমস্যা প্রতিকারহীন।

ট্র্যাফিক জ্যাম

কলকাতাবাসীর কাছে ‘ট্রাফিক জ‍্যাম’ অতিপরিচিত শব্দ। রাজপথ গুলিতে যেন জনস্রোত বইছে ,তার উপর মানুষের টানা রিক্সা ,ঠেলাগাড়ি ও ঝাঁকামুটের মিছিল, ওই উত্তাল প্রবাহ ডিঙিয়ে গাড়ি গুলি গতিসম্পন্ন হতে না পারলেই ট্র্যাফিক জ্যাম। ট্রাফিক জ্যাম এড়াবার জন্যে পুলিশ বাহিনীর সদা জাগ্ৰত ‘সেল’ দিন-রাত কাজ করছে, কিন্তু তাতেও পরিত্রান কোথায়? অফিস সময়ে দুর্বিষহ অবস্থা। ট্রামে বাসে নিরুপায় মানুষ বাদুড় ঝোলা হয়ে যাতায়াত করে।

সমস্যা সমাধানের উপায়

পরিবহন- সমস্যার প্রতিকারের জন্য প্রধানত দুটি ব্যবস্থাগ্রহণ একান্ত প্রয়োজনীয়। এক –বর্ধিত জনসংখ্যার অনুপাতে যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি ও তাদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ। দুই– রাজপথ গুলিতে প্রশস্তিকরণ, যাতে আপ ও ডাউন গাড়ি স্বচ্ছন্দে যাতায়াত করতে পারে। সেই সঙ্গে পায়ে চলা পথচারীর জন্য দরকার প্রশস্ত ও পরিচ্ছন্ন ফুটপাত। লক্ষ্য রাখা দরকার, পথের সংযোগস্থল গুলিতে গাড়ি যাতে আটকা পড়ে যানজটের কারণ না হয়ে দাঁড়ায়। সুখের বিষয়, সরকার দুটি বিষয়ের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। এই উদ্দেশ্যে ‘সি.এম .ডি.এ.’ আর ‘সি .এম. পি. ও.’ প্রভৃতি সংস্থা গঠিত হয়েছে। সংকীর্ণ রাস্তা ভেঙে চওড়া করা হচ্ছে, যেখানে তা সম্ভব নয়, সেখানে ব্রিজ ,ওভার ব্রিজ, কিংবা উড়াল পুল তৈরি হচ্ছে। রবীন্দ্র সেতুর যানবাহনের ভিড় কমানোর জন্য দ্বিতীয় হুগলি সেতু নির্মিত হচ্ছে। কলকাতা মহানগরী কে ঘিরে চক্ররেল প্রকল্পের আংশিক রুপায়ন হয়েছে –অবশিষ্ট হচ্ছে। তাছাড়া রূপায়িত হচ্ছে পাতাল বা ভূ-গর্ভস্থ রেলপথ।

পাতাল রেল প্রকল্পের বিভিন্ন পর্যায়

পাতাল রেল প্রকল্পের রচয়িতা ‘সি.এম.পি ও.’ রচনাকাল ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে। প্রকল্পের রূপকার ও তত্ত্বাবধায়ক হলো পূর্ব রেল বিভাগের Metropolitan Transport Project. ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে পাতাল রেল প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। তিনটি পর্যায়ে পাতাল রেলপথ স্থাপন সম্পূর্ণ হবে। দমদম থেকে টালিগঞ্জ পর্যন্ত প্রায় ১৬ কি.মি রেলপথ স্থাপন প্রথম পর্যায়, দ্বিতীয় পর্যায়ে টালিগঞ্জ থেকে গড়িয়া দীর্ঘ ৮ কি.মি ও বিধান নগরী থেকে রামরাজাতলা পর্যন্ত ১৭ কি.মি তৃতীয় বা শেষ পর্যায়ে দক্ষিনেশ্বর থেকে ঠাকুরপুকুর পর্যন্ত প্রায় ২৬ কি.মি। প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রকল্প ও প্রস্তুত।

রূপায়ণ

দমদম থেকে টালিগঞ্জের মধ্যে থাকবে ১৭ টি রেল স্টেশন।এই দীর্ঘ পথের কাজ সম্পন্ন হওয়ার আগে এ্যাসপ্ল্যানেড- ভবানীপুরের ৪ কিমি আর দমদম বেলগাছিয়ার ২ কিমি পথে গাড়ি চলাচল শুরু হয়েছিল ১৯৮৪-র ২৪ শে অক্টোবর। দমদম থেকে টালিগঞ্জ পর্যন্ত গাড়ি নিয়মিত চলাচল করছে।

পালনীয় নির্দেশ

গাড়িতে ওঠা নামার ব্যাপারে যাত্রীসাধারণের কয়েকটি নির্দেশ পালনীয়। প্লাটফর্মে পৌঁছানোর আগে সিঁড়ি দিয়ে নেমে করিডোর পার হয়ে বুকিং কাউন্টারে প্রয়োজনীয় টিকিট সংগ্রহ করে ঘুরন্ত গেট অতিক্রম করতে হয়। গাড়ির দরজায় দাঁড়ানো একান্ত নিষিদ্ধ। কারণ গাড়ি ছাড়ার আগে দরজা বন্ধ হয়ে যায়। দরজা বন্ধ হলে তবে গাড়ি ছাড়ে। নিষিদ্ধ অনেক কিছু ,যেমন —রেললাইনে নামা ,দাহ্য পদার্থ পরিবহন, জানালার বাইরে শরীর নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি। জরুরী প্রয়োজনের জন্য আছে ‘এলার্ম নব’।

উপসংহার

কেউ কেউ বলেছেন — কলকাতা দুঃস্বপ্নের নগরী। বৃহত্তর কলকাতার সর্বাঙ্গিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে তার পরিবহন সমস্যার অভিশাপ দূর হলে, কলকাতা নিশ্চিত সুখের স্বর্গ হবে, এবং আশা করব, সে সুখ স্বর্গারোহণের প্রথম সোপান হবে পাতাল রেলের স্বাচ্ছন্দ‍্য ভরা পরিবহন।


কলকাতার পরিবহন সমস্যা ও সমাধানের উপায় (Transport Problems of Kolkata and Solutions)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Posts
Scroll to Top