একটি বর্ষণমুখর দিন রচনা (A Rainy Day)

“উতল ধারা বাদল ঝরে”
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ভূমিকা

আজ মেঘমেদুর একটি বর্ষণমুখর দিন। সকাল থেকে ‘বর্ষা এলায়েছে তার মেঘময় বেণী।’ বিরতিবিহীন তার ধারাবর্ষণে গ্রীষ্মের দহনতপ্ত বক্ষে নেমে এসেছে কোমর শান্তিপূর্ণ সজল স্নিগ্ধতা। চোখে লাগে নবীন মেঘের নীল অঞ্জন, আমার হৃদয় মনে লাগে বর্ষাদিনের সজল স্নিগ্ধ স্পর্শ ।আকাশে মেঘের’ পরে মেঘ জমে আছে।দিগন্তের পরপার থেকে বাঁধনহারা বৃষ্টিধারা ধেয়ে আসছে। ‘গুরুগুরু মেঘ গুমরি’ গুমরি’ গরজে গগনে গগনে । এমন দিনটিতে কোন কাজে মন বসে না। মুক্ত বাতায়ন -পথে দু’চোখ ভরে বর্ষণ – হর্ষভরা ধরণীর পুলক -রোমাঞ্চিত রূপ দেখি, হৃদয়ে ভরে উপভোগ করি আর অন্যান্য রূপ-সৌন্দর্য।

গ্রামকেন্দ্রিক বর্ষার দিনের রূপ

সৌন্দর্য: ‘নীল অঞ্জনঘন পুঞ্জছায়ায় সমবৃত অম্বর।’ আকাশে তিল ঠাঁই নেই। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝলসানি। আলের বনে থেকে থেকে ঝড়ের দোলা, তালের পাতায় পাতায় বাজে বাদল মেঘের মাদল। মাঠ জলময়। বাসায় কিংবা নিরাপদ আশ্রয় ভীতিবহুল পাখিরা কাটাচ্ছে তাদের অলস কর্মহীন দিন। যূথী- মল্লিকা-কেয়া- হাসনুহানার গন্ধে বাতাস মাতাল। গোয়ালের গরুগুলি ডাকছে। গ্রামের কৃষকের আর টোকা মাথায় আজ ধানের চারা রোপনে ব্যস্ত। পথ কর্দমাক্ত, জনবিরল। দূরে শ্যামায়নমান গ্রামরেখা বৃষ্টির আড়ালে বিলীন। এমন দিনে মনে ভাসতে থাকে রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গান, বর্ষার কবিতা।

বর্ষার চিত্র-গীতিময় রূপ

আজ বর্ষার অলস মেয়ে মেঘকজ্জল দিনের নয়নরঞ্জন শ্যামশ্রী এবং আকাশের অপরূপ মেঘমাধু(য) আমার হৃদয় – মন পূর্ণ করে দিয়েছে। দূরে শ্যামায়মান অস্পষ্ট গ্রামরেখা, আদিগন্ত জলবিস্তারের মধ্যে শস্যশিশুদের বায়ুসহ (ন)ত্য, আকাশে কৃষ্ণ-ধূসর সজল মেঘের স্তর-বিন্যাস, সুদূর দিগন্ত- বিলাসীর বক-পঙক্তির নিরুদ্দেশ- যাত্রা – সবাই আমার দৃষ্টিতে কোনো অলৌকিক শিল্পীর তুলিতে আঁকা এখানে নয়নাভিরাম যেন। ছিন্ন নদীটি আজ জলস্রোতে উত্তাল। তাতে আজ খেয়া-পারাপারও বন্ধ। উদ্যত বাহু অরণ্য মাথায় আকাশ ভরা মেঘ নিয়ে দুলছে এক সমবেত নৃত্যছন্দে। পত্রমর্মরে ভেক- ডাহুক – ময়ূরের ডাকে ,বাতাসের হাহাশব্দে যে ঐকতান সৃষ্টি হচ্ছে, তার তুলনায় নেই। দূরে কুটিরের সারির চালের ওপরে উত্থিত – কুণ্ডলী পাকানো ধুমরাশি বর্ষার এই অপরূপ চিত্রকে যেন পূর্ণতা দান করেছে।

বর্ষার দিনে কলকাতার রাস্তার দৃশ্য

আজ শহরের আকাশেও টাঙানো হয়েছে মেঘের সামিয়ানা। বর্ষণমুখর কলকাতার গলির মুখে গোলাপ জল থই- থই করছে, জলে ভাসছে বড়- বড় রাজপথ। পার্ক গুলি যেন লেকের ক্ষুদ্র সংস্করণ। আজ ছাতা ও বর্ষাতির ভিড়ে কলকাতার পথ-ঘাটের চেহারা গেছে বদলে। পথচারীদের কেউ-বা গাড়ি বারান্দায় নিচে নিরাপদ আশ্রয় গ্রহণ করেছে, কেউবা বৃষ্টিতে ধোপদুরস্ত পোশাক-পরিচ্ছদের আভিজাত্য অক্ষুন্ন রাখবার ব্যর্থ চেষ্টায় হাঁটুজল বিয়ে গন্তব্যস্থলের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ভারী জাহাজ এর মত শহরের বাঁশগুলি রাস্তায় জল তরঙ্গ সংঘাত সৃষ্টি করে চলেছে ছুটে। বিশেষত ‘ডাবল ডেকার’ গুলি জল নিয়ে অগ্রসর দৃশ্য সত্যিই উপভোগ্য। আরোহীরা স্বল্প টিকিটে কলকাতার রাস্তায় স্টিমার ভ্রমণের আনন্দ লাভ করেছে জলের আবর্ত রেখা দোকানগুলোর উপকূল স্পর্শ করে। পথচারীদের বেশবাস সিক্ত। বর্ষার আগমনে আজ কলকাতার শিশুদের মনের আনন্দ বাধা মানে না। তারাই সর্বপ্রথমে ছড়া কেটে বর্ষার আগমনী গেয়ে ওঠে: ‘টাপুর টুপুর নদেয় এলো বান।

কলকাতার বর্ষার দিনে নাগরিক জীবন

মেঘে মেঘে কখন বেলা হয়ে গেছে, কেউ জানতে পারেনি। কে যাবে অফিসে ?যারা গেছে তারা মাঝপথে বিপদে পড়েছে কিংবা অফিস থেকে ফেরার পথে দুর্ভাবনায় ব্যাকুল। যারা অফিসে যায়নি তারা বাড়িতে মহা আনন্দে মেতে উঠেছে গান শোনায় কিংবা গল্পের বই পড়ার কিংবা টিভি দেখায়। স্কুল-কলেজের আজ বহু বাঞ্ছিত ‘রেনি- ডে’। খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ গাঁজার গন্ধে ম’ ম’ করছে সারা বাড়ি। দোকানে তেলে ভাজার গন্ধ। তারই মধ্যে একটি করুন রাগিণীর মত বেজে চলেছে রাস্তায় রিকশার ঠুন ঠুন আওয়াজ।

আলোকের পেছনে অন্ধকার

শহরে যানবাহন চলাচল আজ বিপ(য)ন্ত। পায়ের জুতোর ঘটেছে পদোন্নতি! মহিলাদের অসুবিধার অন্ত নেই। ধোপদুরস্ত বাবুরা কোথাও ঠেলা গাড়িতে চড়ে জলমগ্ন রাস্তা পারো হচ্ছেন। সে এক কৌতুক পূর্ণ দৃশ্য। নবধারা জলে প্রাসাদ বই কলকাতার মুখে হাসি ফুটল অদূরে তার দারিদ্র্য-পীড়িত বস্তিগুলির চোখে জল। রান্না খাওয়া বন্ধ।

অন্ধকারের ইতিহাস

নোংরা জলের আক্রমণ থেকে গৃহস্থলী দ্রব্যসামগ্রী ও বিছানাপত্র বাঁচাতে আজ বস্তিবাসীদের প্রাণান্ত। প্রাসাদ- নগরী কলকাতার জল নিষ্কাশন সমস্যা বর্ষাকালের একটি চিরন্তন ব্যাপার। বর্তমানে কে.এম.ডি.এ. এর সমাধানে যথেষ্ট যত্নশীল। কিন্তু কলকাতায় যারা বস্তিবাসী, ফুটপাত তাদের একমাত্র আশ্রয় এবং যারা রোজ আনে রোজ খায় তাদের অসুবিধার অন্ত নেই। আজ রিক্সাওয়ালাদের কষ্ট অত্যন্ত বেশি ,কিন্তু তারা আজ বৃষ্টির সুবাদে কিছু অধিক রোজগারের সুযোগ পেয়েছে।
প্রাসাদ ময়ী কলকাতার বর্ষার দিনে মেঘ সৌন্দর্য নেই,পত্রমর্মর নেই,পক্ষী কাকলি নেই,- বর্ষণ- সৌন্দর্যের কিছুই এখানে নেই ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আর সুর করে ছড়া কাটে না – ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদেয় এলো বান।’ শিব ঠাকুর এখন আর বিবাহের সাজে সাজেন না।’ রাজধানী পাষাণ-কায়া।’ বাতায়ন- পথে শোনা যায় রবীন্দ্রকাব্যের আবৃতি কিংবা ক্যাসেট সিডিতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের বর্ষার গান। তাই-ই আজকের বর্ষণমুখর দিনের অনিবর্চনীয় সৌন্দর্য।


অনুরূপ 

  • বর্ষার দিন রচনা
  • একটি বর্ষার দিনের অভিজ্ঞতা রচনা
  • বৃষ্টিমুখর দিন
  • একটি বর্ষণমুখর দিন অনুচ্ছেদ
  • একটি বৃষ্টিমুখর দিন রচনা
  • বর্ষণমুখর একটি দিন রচনা
  • বর্ষাকাল অনুচ্ছেদ রচনা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Posts
Scroll to Top