জনমত গঠনে গণমাধ্যমের ভূমিকা (The role of media in shaping public life)

ভূমিকা:

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় জনমতের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জনমতের যেমন দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মতামত প্রতিফলিত হয়, তেমনি সরকার গঠনের জন্য জনমত সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে। একনায়কতন্ত্রে কিংবা সমাজবাদী রাষ্ট্রে জনগণের স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার অত্যন্ত সীমিত। সে যাই হোক, আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এবং সমাজ জীবনের যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ সমস্যায় জনমত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। কিন্তু, ব্যক্তিবিশেষের জনমত তেমন মূল্য বহন করে না। কারণ তা সামাজিক জীবন ও রাষ্ট্রকে তেমন ভাবে প্রভাবিত করতে পারে না। অসাধারণ প্রভাবশালী বিরল ব্যক্তিত্ব জনমতকে প্রভাবিত করতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্র ব্যবস্থায় তা না ও গৃহীত হতে পারে। আধুনিক যুগে বিভিন্ন গণমাধ্যম জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে থাকে।

জনমতের সংজ্ঞার্থ:

জনমত সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি প্রচলিত আছে। তবুও মোটামুটি ভাবে বলা যায়, সমাজের স্বার্থ সম্পর্কিত জনগণের মতামতের সমষ্টিকে জনমত বা পাবলিক ওপিনিয়ন বলা হয়।আরো বিশদ করে বলা যায়, সমাজের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সম্পর্কে সুনিশ্চিত জনকল্যাণকর এবং বলিষ্ঠ ও সুসংবদ্ধ মত ই হল জনমত। এই জনমত সরকার ও জনগণের উপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। জনমতের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো ঘটনা বা তথ্যের উপলব্ধি, তথ্যের বিশ্লেষণ ও যুক্তিসিদ্ধ ধারণা গঠন এবং ধারণা বা তথ্যের নৈতিক ব্যাখ্যা দ্বারা জনমত গঠন।

গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনমতের গুরুত্ব:

গণতন্ত্রের সাফল্য নির্ভর করে সরকারি নীতি ও কার্যাবলী কে নিয়ন্ত্রণের জন্য সুষ্ঠু সুগঠিত কার্যকর জনমতের ওপর। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের উপযুক্ত ব্যবস্থার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখা দরকার। তবে জনমত গঠনে বিভিন্ন গণমাধ্যমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ |

বিভিন্ন গণমাধ্যম ও জনমত:

যেসব গণমাধ্যম, জনমতকে প্রত্যক্ষভাবে প্রবাহিত করে সেগুলির মধ্যে সংবাদপত্র, চলচ্চিত্র, দূরদর্শন, বক্তৃতা মঞ্চ বা সভা-সমিতি, রাজনৈতিক দলের মুখপত্র, এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আইনসভা, পরিবার, বন্ধু-বান্ধব প্রভৃতির নাম উল্লেখ করা যায়। তবে গণমাধ্যম বলতে সংবাদপত্র, দূরদর্শন ও চলচ্চিত্রের নির্দেশ করা হয়ে থাকে।

সংবাদপত্র ও জনমত:

সংবাদপত্রকে বলা হয় ‘বিশ্বের বাতায়ন’। সংবাদ প্রতিবেদন, সম্পাদকীয় প্রবন্ধ, বিভিন্ন গুণী ও বিশেষজ্ঞ ব্যক্তির সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে পাঠকবৃন্দ দেশের ও বিদেশের বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে অবহিত হতে পারে। তাছাড়া পাঠকগোষ্ঠীর মতামত প্রকাশের মাধ্যমে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কোন সমস্যার বিশ্লেষণ হতে পারে। সংবাদপত্রের এই তথ্য সরবরাহ ও বিচার-বিশ্লেষণ জনমত গঠনে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে।

বেতার ও জনমত:

শিক্ষিত জনমানুষের সংবাদপত্রের আবেদন আছে, কিন্তু অশিক্ষিত, নিরক্ষর মানুষের শিক্ষা ও সমাজ চেতনার প্রসারে বেতার ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম। স্বদেশ ও জাতীয় জীবনের বিভিন্ন সমস্যা শুনে নিতান্ত অজ্ঞ জনসাধারণ ও নিজস্ব মতামত গড়ে তুলতে পারে।

চলচ্চিত্র ও জনমত:

বর্তমান জগতে চলচ্চিত্র জনমত গঠনের এক শক্তিশালী মাধ্যম। চলচ্চিত্র বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার দৃশ্যমান ও শ্রুতিগ্রাহ্য রূপ উপস্থাপিত করে অশিক্ষিত দর্শক-শ্রোতাকে ও জনমত গঠনে সহায়তা করে। বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা ও বিশেষজ্ঞদের উপস্থিত বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের বক্তব্য পেশ করেন। আজকাল নির্বাচনের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল নিজের দলের মতাদর্শ ও কর্মসূচি প্রচার করে জনমত প্রবাহিত করার চেষ্টা করে।

দূরদর্শন ও জনমত:

দূরদর্শন বৈদ্যুতিক মাধ্যমের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম। দূরদর্শন অত্যন্ত মনোজ্ঞরূপে বিভিন্ন বিষয় পরিবেশন করে জনমতকে প্রত্যক্ষ ভাবে প্রভাবিত করে। দূরদর্শন যেমন বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা দিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত প্রচারের ব্যবস্থা করে তেমনি দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা ও নানা দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করে সাধারণ নির্বাচনের পূর্বে প্রণয় রায়,নন্দিনী সিং প্রভৃতি বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে তাঁদের কর্মসূচি দর্শক সমক্ষে প্রচার করা হয়। ফলে, দর্শক-শ্রোতারা তাদের পছন্দের দল বেছে নিতে পারেন।

জনমত গঠনে অন্যান্য প্রচার মাধ্যম:

অল্প শিক্ষিত ও নিরক্ষর ব্যক্তির কাছে সভা-সমিতির বিশ্লেষণমূলক আলোচনার বিশেষ মূল্য রয়েছে। রাজনৈতিক নেতা, পন্ডিত ব্যক্তি, সাংবাদিক প্রভৃতি বক্তৃতার মাধ্যমে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সমস্যা শ্রোতাদের কাছে উপস্থাপন করতে পারেন। বিশেষত, নির্বাচনের পূর্বে চতুর্দিকে তাই সভা-সমিতির হিড়িক পড়ে যায়। আবার পোস্টার ব্যানার ও অন্যতম প্রচার মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।

উপসংহার:

গণমাধ্যমগুলির সর্বাতিশায়ী প্রভাব যাতে সংকীর্ণ স্বার্থে ব্যবহৃত হতে না পারে সে জন্য সতর্ক থাকা প্রয়োজন। বেতার,চলচ্চিত্র ও দূরদর্শন এর মতো রাজনৈতিক প্রচারে বলিষ্ঠ মাধ্যমগুলির যতদূর সম্ভব সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব মুক্ত রাখতে হবে। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার বহু টালবাহানার পর ‘প্রসার ভারতী’ নামক সংস্থা গঠন করেছেন। মনে রাখতে হবে প্রচারযন্ত্র সরকারি নিয়ন্ত্রণের বাইরে রাখতে না পারলে ‘গোয়েবেলসীয়’ তত্ত্বে বহুবার উচ্চারিত মিথ্যা সত্যরূপে জনগণকে প্রতারিত করতে পারে। সুতরাং সুস্থ বলিষ্ঠ সুচিন্তিত জনমত প্রকাশ ও গঠনের মাধ্যমের পাশাপাশি উপযুক্ত সামাজিক পরিবেশের ও যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Posts
Scroll to Top