বিজ্ঞান ও মানব সভ্যতা ( Science and Human Civilization)

বিজ্ঞান ও মানব সভ্যতার সত্যকার স্বরূপটি চিন্তা করলে কবি প্রেমেন্দ্র মিত্রের উদ্ধৃত কবিতাংশটির কথা প্রায়ই মনে আসে। যে ঈশ্বর পৃথিবী ও পার্থিব জীবনকে সুখ সৌন্দর্য সৌভাগ্য সম্পদ স্নেহে প্রেমে ভরিয়ে দিয়েছেন তিনি আবার দিয়েছেন দুঃখ দারিদ্র্য ব্যাধি মৃত্যুর যন্ত্রনা। মানুষের জীবনে বিজ্ঞানের যেন এই দৈত্য রূপ তার একহাতে বরাভয় অন্য হাতে অসি।

ভূমিকা:

“মাটির ঢেলা মাটির ঢেলা রং দিলে কে তোর গায়ে ?
গড়লে তোরে কোন আদরের ছাঁচে?
ভুখ দিলে যে বুক দিলে যে দুঃখ দিতে সে ভুলল না ,
মৃত্যু দিলে লেলিয়ে পাছে পাছে।”

বিজ্ঞান ও মানব সভ্যতার সত্যকার স্বরূপটি চিন্তা করলে কবি প্রেমেন্দ্র মিত্রের উদ্ধৃত কবিতাংশটির কথা প্রায়ই মনে আসে। যে ঈশ্বর পৃথিবী ও পার্থিব জীবনকে সুখ সৌন্দর্য সৌভাগ্য সম্পদ স্নেহে প্রেমে ভরিয়ে দিয়েছেন তিনি আবার দিয়েছেন দুঃখ দারিদ্র্য ব্যাধি মৃত্যুর যন্ত্রনা। মানুষের জীবনে বিজ্ঞানের যেন এই দৈত্য রূপ তার একহাতে বরাভয় অন্য হাতে অসি। সভ্যতার আদি লগ্নে খাদ্য ও আশ্রয়ের সন্ধানে যাযাবর মানুষ ছিল প্রকৃতির কাছে অসহায়। তারপর মানুষ তার শাণিত বুদ্ধি ও বিপুল সিজন প্রতিভার বলে প্রকৃতিকে জয় করেছে। শ্বাপদ সংকুল অরণ্যভূমি হয়ে উঠেছে তার সুষম বাসভূমি। এক কথায় মানব সভ্যতা তার জন্মের উষালগ্ন থেকে যার হাত ধরে ধীর পদক্ষেপে গৌরবোজ্জ্বল আলোর দিকে এগিয়ে এলো সে হলো বিজ্ঞান।

মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশ ও বিজ্ঞান:

মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশে বিজ্ঞানের দান অপরিসীম। এর প্রমাণ পাওয়া যায় বিজ্ঞানের বিভিন্ন আবিষ্কার থেকে। মানব সভ্যতার যেকোন ক্ষেত্রে চোখ মেললেই দেখা যায় বিজ্ঞানের অবদান।

কৃষি ক্ষেত্রে বিজ্ঞান :

কৃষক আজ গ্রহণ করেছে বিজ্ঞানের দান। উন্নত বীজ, উৎকৃষ্ট সার, কীটনাশক ওষুধ, বিজ্ঞান আবিষ্কার করেছে। জল সেচের পাম্প মেশিন ,ভূমিকর্ষণ এর জন্য ট্রাক্টর ও পাওয়ার টিলার শস্য ঝাড়াই মাড়াইয়ের যন্ত্র বিজ্ঞানের বিস্ময়কর অবদান। মাটি পরীক্ষার মাধ্যমে কৃষকরা বুঝে যাচ্ছেন কোন মাটিতে কি ফসল হতে পারে। ডিপ টিউবওয়েল বসিয়ে একই জমিতে তিনবার ফসল উৎপাদিত হচ্ছে ।

যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে বিজ্ঞান:

বিজ্ঞান আজ দূরকে করেছে নিকট। পৃথিবীর কে এনে দিয়েছে ঘরের কোণে। দূর দূরান্তে আজ আমরা সহজেই পাড়ি দিতে পারি। পৃথিবীতে বসে চাঁদে দাঁড়িয়ে থাকা অভিযাত্রীর সঙ্গে কথা বলা যায়। যানবাহন ব্যবস্থা এতই উন্নত যে সকালে দিল্লীতে বসে প্রাতরাশ সেরে দুপুরে কলকাতায় বসে মধ্যাহ্নভোজন করা যায়। টেলিগ্রাফ ও টেলিফোন ব্যবস্থার কল্যাণে দূর-দূরান্তে থাকা প্রিয়জনের সঙ্গে ডায়াল ঘুরিয়ে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কথা বলা যায়।

মনোরঞ্জন:

বিজ্ঞান মানুষের মনোরঞ্জনের জন্য বিশেষ ভূমিকা নিয়েছে। রেডিও-টিভি ভিডিও টেপ রেকর্ডার মানুষকে আনন্দ দান করেছে। টিভির মাধ্যমে মানুষ বাড়িতে বসে চ্যানেল ঘুরিয়ে দৈনদিন নতুন-নতুন মনোরঞ্জন কারা অনুষ্ঠান দেখতে পাচ্ছে। মানুষের একঘেঁয়েমি ক্লান্তিকর জীবনে বিজ্ঞান এনে দিচ্ছে বৈচিত্র।

স্বচ্ছন্দ বিধান:

মানুষ নিজের স্বাচ্ছন্দ বিধানের জন্য পাখা, লিফট, ফ্রিজ, ভিডিও, ওয়াশিং মেশিন, হিটার, কুকার রান্নার গ্যাস ইত্যাদি ব্যবহার করতে পারছে বিজ্ঞানের কল্যাণে।

শিক্ষা:

শিক্ষাক্ষেত্রেও বিজ্ঞানের অবদান যথেষ্ট। বই.খাতা, চক ,ডাস্টার, গ্লোব, মানচিত্র, কম্পিউটার, ক্যালকুলেটর শিক্ষাব্যবস্থাকে সহজ করেছে।

চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞান:

চিকিৎসা বিজ্ঞানে আজ এসেছে যুগান্তর। মানুষ বহু দুরারোগ্য ব্যাধি কে নির্মূল করতে পেরেছে। যেমন—- কলেরা ,বসন্ত , টাইফয়েড ,যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়া। সার্জারির ক্ষেত্রে ও ঘটেছে অভাবনীয় উন্নতি। হার্টের সার্জারি করে আজ মানুষকে জীবন দান ও বিজ্ঞানের দান।

জীববিজ্ঞান:

জীবদেহের গঠন ও প্রাণের রহস্য ভেদ করার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অবদান স্মরণীয়। ডারউইন,ল্যামার্ক প্রমুখ বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার এর পথ ধরে হার্ভে জীব দেহে রক্ত সঞ্চালনের উপর আলোকপাত করলেন। প্যাভলভ জীবদেহের গঠন প্রকৃতির উপর গবেষণা করে যুগান্তর আনলেন |

মহাকাশ বিজ্ঞান:

মহাকাশ বিজ্ঞানের বিস্ময়কর অগ্রগতি হয়েছে। মানুষ আজ চাঁদে পাড়ি দিচ্ছে রকেট পাঠিয়ে মঙ্গল ও শুক্র গ্রহের ছবি তুলছে। শুধু তাই নয় পরমাণু রহস্য ভেদ করেও পরমাণু ভাঙার পদ্ধতি উদ্ভাবন করে মানুষ আজ অসীম ক্ষমতার অধিকারী।

খাদ্য:

পুষ্টিবিজ্ঞান আজ আমাদের সুষম খাদ্যের তালিকা প্রস্তুত করে দিয়েছে। যা আমাদের জীবন ধারণের ক্ষেত্রে একান্ত প্রয়োজন।

বিজ্ঞানের ব্যাপ্তি:

মানব সভ্যতার সর্বক্ষেত্রেই আজ বিজ্ঞানের ব্যাপ্তি। সমুদ্রবিজ্ঞান, আবহাওয়া বিজ্ঞান ,জ্যোতির্বিজ্ঞান প্রভৃতি বিজ্ঞানের নানা শাখায় বিজ্ঞান আজ ফলে ফুলে প্রস্ফুটিত।

বিজ্ঞানের ভালো মন্দ:

কিন্তু ঈশ্বরের কোন সৃষ্টি নিখুঁত নয়।যে সূর্য প্রাণ দেয় সেই আবার দহন করে যে বিদ্যুৎ শিখা দৃষ্টিনন্দন তারই স্পর্শ মৃত্যু ঘটায়। বিজ্ঞানের ও ভালো মন্দ দুটি দিক আছে। যে আণবিক শক্তি মানুষের অশেষ কল্যাণ সাধন করতে পারে সেই শক্তির তৈরি বোমায় হিরোশিমা-নাগাসাকির মতো শহর নিমেষে ধ্বংস হয়ে যায়। তাই আমাদের মনে প্রশ্ন জাগছে তবে কি বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ !

অন্যান্য ক্ষেত্রে বিজ্ঞান:

যে নদীকে দেখে মানুষ একদিন ভয় পেত সেই নদীতে বাঁধ দেওয়া হচ্ছে , জল সেচ করা হচ্ছে, সেতু নির্মাণ, পাহাড় কেটে সুরঙ্গ নির্মাণ ,গগনচুম্বী বৈজ্ঞানিক, অট্টালিকা নির্মাণ করে চলেছে আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যা। কৃত্রিম উপগ্রহ ইনস্যাট 1এ ইনস্যাট 1বি প্রভৃতির মাধ্যমে দূর-দূরান্তের বিভিন্ন খবরা খবর জানতে পারি। খনিতে যে বিপুল খনিজ সম্পদ সুপ্ত ছিল তার ঘুম ভেঙেছে বিজ্ঞানের ছোঁয়ায়।

উপসংহার:

একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যায় বিজ্ঞানের দোষ নেই মানুষ তাকে যেভাবে ব্যবহার করবে তার ফল সেভাবেই ফলবে। সুতরাং মানুষের সার্বিক কল্যাণ সাধনায় বিজ্ঞানকে কাজে লাগাতে হবে। ও প্রয়োগ করলে মানব সভ্যতার ধ্বংস অনিবার্য। কিন্তু বিজ্ঞান কে বাদ দিয়ে আমরা জীবনের অস্তিত্ব চিন্তাই করতে পারি না। ব্রিটিশ বিজ্ঞানী হলডেনের কথার সমর্থনে বলতে পারি –

“We need science more than ever before and we must think scientifically not only about wrappers and health but about politics and philosophy.”.

কারণ আমরা জানি,

‘Without love science is destructive and without science love is worthless.’

শক্তির কাছে যদি প্রাণের মাধুর্য নির্বাসিত হয় গল্প যদি আনন্দের চেয়ে বেশি মূল্যবান হয় প্রতাপ যদি প্রেমের উপর আধিপত্য বিস্তার করে তবে যন্ত্রসভ্যতার ব্যর্থতা অবধারিত। তাই সমস্ত বিভেদ, বিসংবাদ ভুলে বিশ্বমানবের কল্যাণে বিজ্ঞানের জয়যাত্রা আগামীদিনে অবাধ, শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ হোক —–এই আমাদের পার্থনা।


সমাপ্ত


0 thoughts on “বিজ্ঞান ও মানব সভ্যতা ( Science and Human Civilization)”

  1. There is no option to download it as a pdf if there is an option to download rachana as a pdf it will be best site to download rachana

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Posts
Scroll to Top