ভূমিকা:
“তোমরা শান্তিতে ঘুমাও , আমরা আর এমন ভুল করবোনা ”
হিরোশিমার স্মৃতিফলকে লেখা আছে ছোট্ট এই কথাটি। হিরোশিমায় অ্যাটম বোম ফেলার 55 বছর পর আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠল বিশ্ব। আমেরিকার ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ও পেন্টাগনের জঙ্গি হামলার সাথে সাথে ওসামা বিন লাদেনের আশ্রয়স্থল আফগানিস্তানের উপর শুরু হল মার্কিনী হুমকি। একদিকে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসী মনোভাব অপরদিকে ক্রমবর্ধমান সন্ত্রাসবাদ এখন বিশ্বের কাছে ত্রাস। শুধু আমেরিকাতেই নয় এ আক্রমণ গোটা সভ্যতার বিরুদ্ধে।
সন্ত্রাসবাদ কি ?
‘হত্যা ইত্যাদি কাজের দ্বারা আতঙ্ক সৃষ্টি হলো সন্ত্রাস আভিধানিক অর্থ অত্যধিক ভয় বা শঙ্কা আর সন্ত্রাসবাদের অর্থ ভীতি শঙ্কা বা আতঙ্ক সৃষ্টিকারী ক্রিয়া-কলাপ প্রদর্শনের অনুষ্ঠান। উদ্দেশ্য অধিকার আদায় ,মাতৃভূমির মুক্ত সাধন, রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের জন্য গুপ্ত হত্যা, গোপন সশস্ত্র অভ্যুত্থান ইত্যাদির সংগঠন। আর এই সব মতবাদ ও কার্যকলাপে বিশ্বাসী যারা, তারা হল সন্ত্রাসবাদি।
বর্তমান সন্ত্রাসবাদ এর চরিত্র:
বর্তমানে একবিংশ শতকে এই নতুন সহস্রাব্দে সন্ত্রাসবাদের চরিত্র বৈচিত্র ও ব্যাপ্তি এক নতুন মাত্রা পেয়েছে। আতঙ্ক সৃষ্টিকারী কোন স্থানীয় ঘটনার আর সেই নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতা নেই। বর্তমানে সন্ত্রাসবাদের ভুবনী করণ হচ্ছে নিয়ত আন্তর্জাতিক কারণ ঘটছে অপ্রতিহত গতিতে। এই নয়া আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদকে বলা হচ্ছে নয়া সন্ত্রাসবাদ বা নিও টেরোরিজম(Neo Terrorism)। এটাকে কেউ কেউ উত্তরাধুনিক সন্ত্রাসবাদ বা পোস্ট মর্ডান টেরোরিজম বলে থাকেন।
সন্ত্রাস সৃষ্টির কারণ:-
সন্ত্রাসবাদের জন্ম কারণ বিবিধ ও বিচিত্র। কট্টর মৌলবাদী চরমভাবাপন্ন চিন্তাভাবনা উগ্র ধর্মান্ধতা , উৎকট স্বজাত্যবোধ, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিচ্ছন্নতার অভাব, বেকারত্ব ,শিক্ষার অভাব, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা এবং তজ্জনিত দারিদ্র এর জন্মদাতা। এর পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে আরো একটি কারণ তা হল এক শ্রেণীর মানুষ যারা তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থে উগ্রবাদী চিন্তায় সন্ত্রাসবাদ প্রচার ও সন্ত্রাস সৃষ্টি করে থাকে। এটাই তাদের পেশা। এছাড়া অর্থের বিনিময়েও দেশে-বিদেশে সন্ত্রাসবাদি কার্যকলাপ আমদানি ও রপ্তানি হচ্ছে। এছাড়া রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও সন্ত্রাস সৃষ্টির অন্যতম কারণ। রাষ্ট্রসংঘ নির্ধারিত সন্ত্রাসের সংজ্ঞা আমেরিকা মানেনি। মেডিকা মানেনি ইজরায়েল ও তার পদাঙ্ক অনুসরণ করেছে। বিশ্ব সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণের নামে আমেরিকার দাদাগিরির মধ্যেও রয়েছে বিশ্ব সন্ত্রাসের বীজ। অনেকের মতে এক হিসাবে তারাও বিশ্ব সন্ত্রাসে ফেরিওয়ালা। ‘ঠান্ডা লড়াই’ এর অবসানের পরিপেক্ষিতে ইহা আরো বেড়েছে |
সন্ত্রাসবাদের উৎসভূমি ও বিশ্বের বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদি গোষ্ঠী:-
কট্টর উগ্র জাতীয়তাবাদ ও মৌলবাদকে আশ্রয় করে নয়া সন্ত্রাসবাদ বর্তমানে পরিচর্চা ও বিস্তার লাভ করেছে উত্তর আফ্রিকার লিবিয়া, আলজেরিয়া , টিউনিশিয়া থেকে সুদান চাঁদ হয়ে পূর্ব আফ্রিকার মরক্কো ও ইথিওপিয়ায়। মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ায় সৌদি আরব, ইরাক ,লেবানন, সিরিয়া, আফগানিস্তানে ও পাকিস্তানের। ইউরোপের বসনিয়া কাসাভো রিয়া ক্রোয়েশিয়া রাশিয়ার চেচনিয়া চীনের জিংজিয়াং এবং ইন্দোনেশিয়াতে। এই সব এলাকায় সর্বত্রই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে নয়া সন্ত্রাসবাদের সৃষ্টি হয়েছে। সন্ত্রাসবাদের উল্লেখযোগ্য গোষ্ঠীগুলো খুবই সক্রিয়। এগুলির মধ্যে পরিচিত গোষ্ঠী গুলি হল—- ওসামা বিন লাদেন পরিচালিত আল-কায়দা এছাড়া অতি সক্রিয় আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ সংগঠনগুলি হল আবু নিদাল তার গা নাই মিশরের আলগামা আল ইসলামিয়া ও আল জেহাজ। পাকিস্তানের হা হরকত আল আনসার লস্করি তইবা জঈশ- ই- মহম্মদ, শ্রীলংকার L.T.T.E, জাপানের রেড আর্মি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
বর্তমান কালের উল্লেখযোগ্য সন্ত্রাসবাদী ঘটনা:-
ইদানীংকালের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ গত 11 ই সেপ্টেম্বর 2001 এ লোয়ার ম্যানহাটনে অবস্থিত ওয়াল্ড ট্রেড সেন্টার এবং ওয়াশিংটনের সামরিক হেডকোয়াটার পেন্টাগনের উপর বিধ্বংসী বিমান হানায় 40 হাজার লোকের মৃত্যু। এর পাশাপাশি বিগত 10 বছরে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য সন্ত্রাসবাদি হামলা এ প্রসঙ্গে উল্লেখের অপেক্ষা রাখে। (১) ১৭ ই মার্চ ১৯৯২:- আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনোস এয়ার্স এ ইজরায়েলি দূতাবাসের বাইরে গাড়িবোমা বিস্ফোরণ। (২) ২৬ শে ফেব্রুয়ারি ১৯৯৩ :- নিউ ইয়র্কে W.T.C তে ভূগর্ভস্থ গাড়ি রাখার জায়গায় ট্রাক বোমার বিস্ফোরণে সহস্রাধিক লোক হতাহত হয়। (৩) ১৮ ই জুলাই ১৯৯৪ :- আর্জেন্টিনায় অবস্থিত ইজরায়েলি আর্জেন্টাইন ভবনে ভবনে গাড়িবোমা বিস্ফোরণে সাত তলা ধ্বংস হয় ও 250 হতাহত হয়। (৪) ৪ ই ডিসেম্বর ২০০০ মস্কোর টিভি টাওয়ারে তিন জনের মৃত্যু ওটিভি সম্প্রচার সাময়িক বন্ধ। সাম্প্রতিক সন্ত্রাসবাদের কুফলতা ও বিষময় পরিনাম এর দুটি জ্বলন্ত উদাহরণ হল ইন্দ্রোনেশিয়া আর বালি দ্বীপে ভয়াবহ বোমা বিস্ফোরণ ও রাশিয়ার মস্কোর একটি থিয়েটারের হলে সন্ত্রাসবাদি হামলা ও পরিণামে বহু লোক ক্ষয় আমাদের হৃদয় কে হিম শীতল করে দেয়। এইভাবে সারা বিশ্ব জুড়ে গত এক দশকে এমনই আরো কত ছোট বড় সন্ত্রাসবাদি আক্রমণ ঘটেছে যে তার সব হিসাব দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তবেই এইসব সংক্ষিপ্ত বিবরণ থেকে এটা পরিষ্কার যে আজ সমগ্র বিশ্বের সন্ত্রাসবাদী হামলা কি রূপ ক্রমবর্ধনশীল।
বর্তমানে ভারতের সন্ত্রাসবাদি ঘটনা:-
ভারতবর্ষ এই সন্ত্রাসবাদের হাতে সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত। পাঞ্জাব, জম্বু -কাশ্মীর, দিল্লি ,মুম্বাই, উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সন্ত্রাসবাদি হামলা দেশের প্রভূত ক্ষতি করছে স্বাধীনতার পরবর্তী কালে বিশেষ করে গত একটানা ১২ বছর ধরে জম্বু কাশ্মীরের মৌলবাদী জঙ্গীদের আক্রমণ আমাদের আতঙ্কিত করে চলেছে। বলাবাহুল্য ভারতের উপর এইসব সন্ত্রাসবাদি হামলার পিছনে পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে। তারমধ্যে ১৯৯৩ সালে দাউদ ইব্রাহিম পরিচালিত মুম্বাই বিস্ফোরণ সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য। গত ২০০১ থেকে এই সংক্ষিপ্ত সময়সীমা টুকু ধরা যাক। (১) ১০ ই ফেব্রুয়ারি ২০০১ :- জম্বু ও কাশ্মীরের সারহী গ্রামে সাতজন শিশুসহ ১৫ জন সন্ত্রাসবাদি গুলিবর্ষণে নিহত হয়।(২) ১লা অক্টোবর২০০১:- আত্মঘাতী বাহিনীর জম্বু কাশ্মীর বিধানসভার হামলায় জঙ্গী সহ ৩১ জনের মৃত্যু। (৩) ১৩ ই ডিসেম্বর ২০০১:- দিল্লির সংসদ ভবনে ৫ জন জঙ্গি সহ ১২জনের মৃত্যু। (৪) ২২ শে জানুয়ারি ২০০৩:- কলকাতার মার্কিন তথ্য কেন্দ্রে সন্ত্রাসবাদী হামলায় নিহত ৪ পুলিশ ও আহত ১৪। (৫) ২০ শে আগস্ট ২০০২ :- ত্রিপুরার সন্ত্রাসবাদি হানায় ২০ জন বি. এস. এফ এর মৃত্যু। শুধু এগুলোই নয় এর পাশাপাশি সন্ত্রাসবাদীদের বিষাক্ত নখ দন্তের প্রসারণ ঘটেছে গুজরাটের স্বামিনাথন মন্দির ও জম্বু কাশ্মীরের রঘুনাথ মন্দির। বর্তমানে ভারতে ঘটে চলেছে একাধিক রেল দুর্ঘটনা। এর পশ্চাতে সন্ত্রাসবাদীদের সুদৃঢ় হস্তক্ষেপ আছে তা আজ প্রমাণিত। গাইসাল রেল দুর্ঘটনা ও রাজধানী রেল দুর্ঘটনা বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলায় সাম্প্রতিক প্রচেষ্টা সমূহ:-
সুখের কথা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে কল্যাণকামী ও শান্তিকামী জনগণ সন্ত্রাসবাদীদের ভয়ঙ্কর ক্রিয়াকলাপের প্রতিবিধানের প্রচেষ্টায় তৎপর হয়েছে আমেরিকা ও তার সহযোগী দেশসমূহ একত্রিত হয়ে সারা বিশ্বের উল্লেখযোগ্য 27 টি জঙ্গিগোষ্ঠীকে চিহ্নিত করেছে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রসঙ্ঘের ভূমিকা ও উল্লেখযোগ্য।
উপসংহার:-
এইভাবে সন্ত্রাসবাদীরা পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে মানব সভ্যতার কবর খুঁড়ে চলেছে। নয়া সন্ত্রাসবাদের মর্মন্তুদ ও নারকীয় হত্যালীলায় আজ সমগ্র মানব সভ্যতার চরম দুর্দিন সমাগত। রেডিও টিভিতে প্রতিদিনই শোনা যায় জঙ্গী হামলার কথা। দিনের পর দিন কত নিরীহ মানুষ প্রাণ বলি হচ্ছে। মাঝে মাঝে জঙ্গিদের নানা হুমকি সাধারণ মানুষের মধ্যে ভয়ের সঞ্চার করছে। জনজীবন হয়ে পড়ছে বিপর্যস্ত। তাই আজ এই প্রশ্নটাই বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে যে তিল তিল করে গড়ে তোলা মানব সভ্যতা কি ধ্বংসের কিনারায় উপনীত। নাকি শান্তিকামী মানষই শেষ পর্যন্ত জয়ের কি কিরীট পড়বে? আসলে এই ভয়াবহ পরিণতি থেকে পরিত্রান পেতে হলে কোন শক্তিগর্বী আস্ফালনে ভীত হলে চলবে না। কোন জাতি বা গোষ্ঠীর ন্যায্য দাবি কে অগ্রাহ্য করলে যেমন চলবেনা তেমনি হিংসাপরায়ণ বিদ্বেষ ও বিভেদকামী রাষ্ট্র বা ব্যক্তি গোষ্ঠী কে চিহ্নিত করে তাদের ধ্বংস সাধনে মত্ত হলে চলবে না সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও একান্ত প্রয়োজন। প্রকৃতপক্ষে মানব সভ্যতার কোন জাত ধর্ম সম্প্রদায় নেই এই বোধে সমগ্র বিশ্ব বিবেক জাগরণের সম্মিলিত স্বার্থ প্রচেষ্টা এখনই শুরু হোক তবে আমরা আবার একদিন সন্ত্রাসবাদ মুক্ত প্রাণোচ্ছল মানব সভ্যতার স্বপ্ন দেখতে পাবো। সেদিন বলতে পারব মানুষের জয় হোক। কিন্তু বিশ্বকে সন্ত্রাস মুক্ত করে প্রশান্তির আলোক তীর্থে উত্তরণ ঘটাতেই হবে। কবি সুকান্তের ভাষায় বলতে হয় –
” এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।”
সমাপ্ত