পরিবেশ রক্ষায় বনসৃজনের ভূমিকা(The role of forestry in protecting the environment)

ভূমিকা

নাগরিক সভ্যতার বিষবাষ্পে রুদ্ধশ্বাস কবি বড় দুধ কে বলেছেন– ‘দাও ফিরে সে অরণ্য লও এ নগর’ একবিংশ শতাব্দীতে পৌঁছে সকলের অন্তরেই বৃক্ষলতার শ্যামলিমার জন্য এই আকাঙ্ক্ষা মুখর হয়ে উঠেছে। যন্ত্রসভ্যতার আশীর্বাদের সঙ্গে সঙ্গে তার অভিশাপ ও মানুষকে বহন করতে হচ্ছে। ঈশ্বর যে অরণ্য, পর্বত,সমুদ্রে ঘেরা পৃথিবী মানুষের জন্য রচনা করেছিলেন ব্যবহারিক প্রয়োজনের তাগিদে মানুষ প্রতিদিন নতুন করে গড়ে তুলেছে। এটা একদিকে যেমন মানব মনীষার জয় ঘোষণা করে, অন্যদিকে তেমনি সমূহ সর্বনাশের ও সূচনা করেছে। বৃক্ষলতা হীন যান্ত্রিক জীবন অস্বাস্থ্য ও নানাপ্রকার ব্যাধির প্রকোপে ব্যতিব্যস্ত। তাই বিশ্বজুড়ে আজ বনসৃজনের প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছে।

বৃক্ষ বিরল জীবনের অভিশাপ

আধুনিক সভ্যতার বিজয় গৌরব বহন করে গড়ে উঠেছে কলকারখানা অধ্যুষিত নগর সমূহ। পরিবহন কার্যে নিয়োজিত রয়েছে অসংখ্য যন্ত্র চালিত যানবাহন। মানুষের বসতি নির্মাণ করতে গিয়ে প্রতিদিন অগণিত বৃক্ষচ্ছেদন করা হচ্ছে। এক একটি শহর হয়ে উঠেছে বৃক্ষলতার স্পর্শহীন পাষান পুরি। কলকারখানা ও যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়ায় আকাশ-বাতাস কলঙ্কিত। এরই পরিণামে সভ্যতা গর্বী মানুষের জীবন জটিল ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। নগরজীবন বৃক্ষ বিরল হয়ে আসায় মানুষের প্রাণের অস্তিত্ব আজ বিপন্ন। পৃথিবীর প্রতিটি দেশে তাই বিজ্ঞানীরা রব তুলেছেন, পরিবেশ দূষণ থেকে বাঁচতে হলে তরুরাজির শ্যামল ছায়ার প্রবর্তন করতে হবে। এক কলকাতা শহরেই নাকি বায়ুমন্ডলে ১৩০০ মেট্রিক টন দূষিত কনা ভেসে বেড়াচ্ছে। এ থেকে শহরতলীর শিল্পাঞ্চলের অবস্থা কল্পনা করা যায়। এই ভয়াবহ অবস্থা থেকে বাঁচতে হলে প্রকৃতির পরিবেশে সাম্য ফিরিয়ে আনতে হবে। তাই বনসৃজন একান্ত আবশ্যক।

বৃক্ষ ও মানব জীবন

গাছ মানব জীবনের এক অমূল্য সম্পদ। হিসাব করে দেখা গেছে একটি গাছ যদি পঞ্চাশ বছর বাঁচে তবে তা থেকে পঞ্চাশ লক্ষ টাকার সমপরিমাণ খনিজ অক্সিজেন পাওয়া যেতে পারে। উদ্ভিদের অভাবে বৃষ্টিপাতের তারতম্য দেখা যায়।বৃক্ষ বহুমূল্য বনজ সম্পদ। তাই একদিকে বৃক্ষ যখন ধ্বংস করা হচ্ছে অন্যদিকে তখন নতুন বৃক্ষের সৃষ্টি করতে হবে। প্রাকৃতিক পরিবেশের সাম্য রক্ষার জন্য দেশের ভূখণ্ডের শতকরা দশ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। ভারতের বননীতি হল সমতলে তেত্রিশ ভাগ এবং পার্বত্য অঞ্চলে তেষট্টি ভাগ বনভূমি রাখতে হবে। প্রাচীন ভারতের তপোবন সভ্যতার মানবজীবনে বৃক্ষলতার গুরুত্ব অনুভব করেছিল। মনীষীদের সাধন ক্ষেত্র, বৃদ্ধাশ্রম প্রভৃতি উদার উন্মুক্ত পরিবেশের মাঝখানে স্থাপিত হত। রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন একাদা সেই আদর্শকেই বাস্তবে রূপায়িত করতে চেয়েছিল। সম্প্রতি ভারতে ও বৃক্ষসম্পদের গুরুত্ব সম্বন্ধে সচেতনতা দেখা দিয়েছে।

বনসংহারের কুফল

শুধুমাত্র সৌন্দর্য বিনাশই নয়, মানুষের অতি প্রয়োজনীয় বাস্তব জীবন ও এই অরণ্য নাশে যথেষ্ট পরিমাণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। কৃষিনির্ভর মানুষের কাছে বৃষ্টিপাত প্রকৃতির এমন একটি অমূল্য উপহার, যার অভাবে মানব জীবনের টিকে থাকাই দায় হয়ে পড়ে। দীর্ঘ উন্নত বৃক্ষরাজি, গভীর অরণ্য প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে কোন ও একটি দেশের বৃষ্টিপাতকে নিয়ন্ত্রিত করে থাকে। নির্বিচারে বৃক্ষ ছেদনের সেই বৃষ্টিপাত অনিয়মিত এবং অনিশ্চিত হয়ে পড়ে যার স্বাভাবিক ফলস্বরূপ দেশের আবহাওয়ায় একদিকে যেমন উত্তাপ বাড়ে অন্যদিকে তেমনি সবুজের সমারোহ ক্রমেই মরুভূমির ঊষর রুক্ষতার বিলীন হয়ে যায়। এইসব প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের অবশ্যম্ভাবী প্রভাব গিয়ে পড়ে কৃষি কর্মের উপর। কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদনের অপ্রতুলতা সমগ্র জাতীয় জীবনে গভীর অর্থনৈতিক সংকটের সৃষ্টি করে। মানুষ ভুলে গেছে, বৃক্ষশোভিত বনভূমি মানব জীবনে অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু, যার সংযোগে জীবন সুখময় হয়ে ওঠে।

পরিবেশ রক্ষায় বনসৃজনের ভূমিকা

অরণ্য ও বনভূমির এই সর্বত্রক উপযোগিতার কথা মনে রেখে পরিবেশ রক্ষায় বনসৃজন ও সংরক্ষণের তাৎপর্যটি উপলব্ধি করতে হবে। মরু বিজয়ের যে কেতন কে শূন্যে উড়িয়ে নিরস জীবনে রসের প্রবর্তনা কে সঞ্চারিত করার বাসনা কবি জানিয়েছেন তার তাৎপর্য এখানেই নিহত আছে। সমীক্ষায় দেখা গেছে জ্বালানির প্রয়োজনে, নাগরিক সভ্যতার বিকাশে প্রতিবছর প্রচুর পরিমাণে বৃক্ষচ্ছেদন ও অরণ্যভূমির নিশ্চিহ্নকরণ ঘটছে,যা অদূর ভবিষ্যতে মানবজাতিকে প্রভূত বিপর্যয়ের সম্মুখীন করবে এবং যার ফলে চিরকালের মধ্যেই এই শ্যামসুশোভন শস্যপূর্ণা বসু রা শ্রীহীন ও সম্পদহীনা হয়ে পড়বে। তাই নতুন নতুন বীজ থেকে নতুন নতুন বনসৃজন অত্যন্ত জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু এদিকেই নয়, মানবজীবনের স্বাস্থ্যের সমৃদ্ধির জন্য ও এই বৃক্ষরোপণ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক, কেননা যন্ত্রসভ্যতার যে বিষ আমরা নিত্য নিয়ত আমাদের প্রশ্বাসের মধ্য দিয়ে আত্মস্থ করেছি তা থেকে একমাত্র গাছপালাই আমাদের রক্ষা করতে পারে।

কর্মসূচি

১৯৫০ সালে সর্বপ্রথম সরকারি উদ্যোগে বনসৃজন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর থেকে প্রতি বছর সরকারি ব্যবস্থাপনায় দেশের সর্বত্র বনসৃজন উৎসব পালন করা হচ্ছে। সরকারের কৃষি বিভাগ থেকে ছায়াপ্রদ দীর্ঘজীবী বৃক্ষের চারা রোপণ করা হচ্ছে। জনসাধারণ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে এই উদ্দেশ্যে বিনামূল্যে চারা গাছ বিতরণ করা হচ্ছে। তবে প্রয়োজনের তুলনায় তা অতি সামান্য। শহরে পৌরপ্রতিষ্ঠানগুলি এবং বৃহৎ শিল্প সংস্থা এই বিষয়ে অগ্রসর হলে যথেষ্ট বৃক্ষরোপণ হতে পারবে। প্রতিটি শহরেই আজ শ্যামল-সবুজ উন্মুক্ত প্রান্তরের অত্যন্ত অভাব। কিন্তু বিদেশে এমনটি হয় না। সেখানে নগর পরিকল্পনার সময় উদ‍্যাধ ও প্রান্তরের জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থা করা হয়। সুতরাং মানুষকে বাঁচতে হলে তার আদিম জীবনের প্রতিবেশী ব্যবস্থা করা হয়। সুতরাং মানুষকে বাঁচতে হলে তার আদিম জীবনের প্রতিবেশী তরুলতা কে‍ ও বাঁচাতে হবে।

উপসংহার

আমাদের এই সবুজ বিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে বনসৃজন এর স্লোগান কে তুলে ধরতে হবে। নিষ্ঠা ও নিয়মের সঙ্গে যত্নবান হতে হবে নতুন বীজ বপণে ও বনসৃজন এর প্রয়োজনে জীবনকে সমৃদ্ধ করতে হবে। করতে হবে সুখী, প্রানবন্ত ও সুন্দর। এই সৌন্দর্য যোগাবে প্রকৃতি আর প্রকৃতি কে সুন্দর করে তুলবে তার অরণ্য ও বন। আণবিক বোমা বিদীর্ণ মৃত্যুশঙ্কাতুর মানুষের জীবনে ও পৃথিবীতে বন সংরক্ষণের চেতনাযই আনবে প্রাণের বার্তা ও সৌন্দর্য সুষমা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Posts
Scroll to Top