বৃক্ষরোপণ উৎসব/ একটি গাছ, একটি প্রাণ (Tree planting festival / a tree, a life)

রবীন্দ্রনাথের ভাষায় –

‘অন্ধ ভূমি গর্ভ হতে শুনেছিলে সূর্যের আহ্বান প্রাণের প্রথম জাগরণে, তুমি বৃক্ষ, আদিপ্রাণ, ঊধ্বশীর্ষে উচ্চারিলে আলোকের প্রথম বন্দনা ছন্দহীন প্রাষাণের বক্ষ পরে,’ |

ভূমিকা:

বৃক্ষ আদিপ্রাণের ধারক। সন্দেহ নেই, তরুলতা জীবের ‘ক্ষুধার জন্যে এনেছিল অন্ন, বাসের জন্য দিয়েছিল ছায়া’।কিন্তু ‘মানুষ অমিতাচারী’। একদিন ‘আশীর্বাদ নিয়ে এসেছিলেন যে শ‍্যামলা বনলক্ষী তাঁকে অবজ্ঞা করে’ সে অভিসম্পাত কে যেন ডেকে লোভ লালসার তাড়নায় অরণ্য কে ধ্বংস করে নিজের ক্ষতি সে নিজেই করল। “বায়ুকে নির্মল করবার ভার যে গাছপালার উপর, যার পত্র ঝরে গিয়ে ভূমিকে উর্বরতা দেয়, তাকেই সে নির্মূল’ করল। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলেছেন, ‘অরণ্য নষ্ট হওয়ায় এখন বিপদ আসন্ন সেই বিপদ থেকে রক্ষা পেতে হলে আবার আমাদের আহ্বান করতে হবে সেই বর দাত্রী বনলক্ষীকে’।

বনের অমর্যাদা, জলবায়ুর উপর প্রভাব:

সন্দেহ নেই, বনলক্ষী অমর্যাদা বহু ক্ষেত্রেই আমাদের ভূপ্রকৃতি ও জলবায়ুর উপর অমোষ ও অনপনেয় প্রভাব বিস্তার করে। যেমন, ভারতবর্ষের উত্তর অংশ তরুবিরল হওয়াতে সে অঞ্চলে গ্রীষ্মের উৎপাত অসহ্য হয়েছে। অথচ ‘এককালে এই অঞ্চল ঋষিদের অধ্যুষিত মহারণ্যে পূর্ণ ছিল, উত্তর ভারতের অংশ একসময় ছায়াশীতল সুরম‍্য বাসস্থান ছিল,’ পুরাণ পাঠক মাত্রেই এ সম্পর্কে অবহিত।’

ধরণীর প্রতি কর্তব্য পালন:

কবি, দার্শনিক ও বিজ্ঞানী নির্বিশেষে সকলেই স্বীকার করেন, প্রতিটি কাজের ঠিক সমান মাপের প্রতিফল উৎপাদন অবশ্যম্ভাবী। আমরা অন্নের জন‍্যে, শস্যের জন্যে বসুন্ধরাকে আঘাত করি, তার অনিষ্ট করি। এই অনিষ্ট নিবারন করার জন্য আমরা তাঁকে যদি কিছু দিই তো আমাদেরই মঙ্গল। বৃক্ষরোপণ এর মধ্য দিয়ে ধরণীর প্রতি কর্তব্য পালন করলে একদিকে যেমন তার ‘ক্ষত বেদনা নিরাময়’ হতে পারে, অপরদিকে তেমনি আবার তরুছায়া ফুল ও ফলের ধরণী ও হয়ে উঠতে পারে শ্যামল সুন্দর। কারণ, প্রবল প্রাণ এর অধিশ্বর বৃক্ষ তো পারে ‘মরুবিজয়ে কেতন’ ওড়াতে। মৌনি মাটির মর্মের গান তরু মর্মরের মধ্যেই তো উচ্চারিত হয়। ‘কোমল প্রাণ’ বলেই না তরুরা পারে ‘করুনার পুণ্যে’ পৃথিবীর ধূলিকে ধন্য করতে, ফুল-ফল পল্লবের মাধুরী সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে।অথএব তরুদের বিনাশ করে নয়, যত্ন ও সমাদর করে, এবং নতুন নতুন তরু রোপন করে আমরা পারি কল্যাণের পথকে প্রশস্ত করতে। মনে রাখতে হবে,

‘একটি গাছ, একটি প্রাণ’।

বন-মহোৎসবের সূচনা, কার্যক্রম,বন- উন্নয়নমূলক বিভিন্ন সংস্থা:

বৃক্ষের গুরুত্ব সম্পর্কে এবং বৃক্ষ রোপনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জনসাধারণকে অবহিত করার জন্য ভারতে ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে বন মহোৎসব নামক অনুষ্ঠান চালু হয়। এই বাৎসরিক উৎসব টি সাধারণত এক সপ্তাহ ধরে চলে। এই সময়ে বাবুল,আম, নিম,বাঁশ ইত্যাদি নানা জাতের বৃক্ষ রোপন করা হয়। ভারতে বন উন্নয়নকল্পে ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে স্থাপিত হয়েছিল ‘দি সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ফরেস্ট্রি,। বনের আয়তন বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে সর্ব ভারতীয় নীতি নির্ধারণ করে কেন্দ্রীয় সরকারকে উপযুক্ত পরামর্শ দেওয়াই এই সংস্থাটির প্রধান কাজ। বন উন্নয়নের ক্ষেত্রে সর্বভারতীয় নীতি কতখানি কার্যকর হচ্ছে তা দেখার জন্যে ‘সেন্ট্রাল ফরেস্ট্রি কমিশন’ গঠন করা হয়। বিভিন্ন রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত এলাকাগুলি বন সংরক্ষণ ও উন্নয়নের উন্নয়নের ক্ষেত্রে কী ভূমিকা নিচ্ছে এই কমিশন সেদিকে লক্ষ্য রাখেন। ভারতে বন উন্নয়ন ও গবেষণা সম্পর্কিত প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি, স্থাপিত হয় দেরাদুনে, ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে। আজ ভারতে বন গবেষণা ও বন উন্নয়ন সম্পর্কিত কাজকর্মের বেশিরভাগই চলে দেরাদুনের ‘ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিট‍্যুট’ এ এবং বাঙ্গালোর ও কোয়েম্বাটুরে অবস্থিত এর দুটি শাখা সংস্থায়।

বন-মহোৎসব ও আমাদের কর্তব্য:

শেষোক্ত কাজটি বন-মহোৎসব বা বৃক্ষরোপণ উৎসব কে কেন্দ্র করে ত্বরান্বিত হতে পারে। তবে লক্ষ্য রাখা উচিত, যাতে শুধুমাত্র একটা আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকান্ডে পর্যবসিত না হয়। সাত দিন বা এক সপ্তাহ কেন,আরো অনেক দিন ধরেই বৃক্ষরোপণ চলতে পারে। মনে রাখতে হবে, বৃক্ষরোপণ বা বন- মহোৎসব সপ্তাহটি হল বৃক্ষ সম্পর্কে আমাদের সচেতন করে তোলার একটি উপলক্ষ মাত্র। এছাড়া, নতুন যে বৃক্ষ বলে কি আমরা রোপণ করছি, তাদের সম্পর্কে যত্নশীল হওয়া ও আমাদের বিশেষ কর্তব্য। ঘটা করে উৎসব করা হল, কোন মান্যগণ্য ব্যক্তি এসে নতুন কিছু শিশুবৃক্ষ রোপণ করলেন,- এবং তার পরে দেখা গেল, কিছুদিন যেতে না যেতেই সেইসব বৃক্ষশিশুরা অযত্নে-অবহেলায় ধ্বংসোম্মূখ অথবা মৃত,এমন বৃক্ষরোপণ উৎসব বা বন মহোৎসবের কোন অর্থ হয় না।

চারাগাছ যেন মানব- শিশু:

বৃক্ষ ঠিক শিশুর মত যত্নে ও ভালোবাসায় বেড়ে ওঠে। ঘটা করে শিশুর জন্মদিন পালন করলেই যেমন দায়িত্ব শেষ হয়না, বছরে একদিন কি এক সপ্তাহ ধরে বনমহোৎসব করলেও ঠিক তেমনি বনের সমৃদ্ধি ঘটে না। আসলে প্রয়োজন নিষ্টা, আন্তরিকতা ও একাগ্রতা। বাড়ন্ত শিশুর ভালো-মন্দ দিকে যেমন সারাক্ষণ লক্ষ্য রাখতে হয়, চারাগাছের পুষ্টি ও বিকাশের দিকে ও ঠিক তেমনি লক্ষ্য রাখা দরকার। এছাড়া, গাছপালার সমৃদ্ধির ফলে অন্য দিক দিয়েও আমরা লাভবান হই। গাছ আমাদের সৌন্দর্য বৃদ্ধি কে উজ্জীবিত করে, মনকে প্রসন্ন করে। অতিরিক্ত বৈষয়িক উন্নতির মোহে বিরাট উদ্ভিদ জগৎ থেকে আমরা নিজেদের ক্রমশ গুটিয়ে নিচ্ছি বলেই আমাদের জীবনে স্বাভাবিক সদ্ গুনের পরিবর্তে কৃত্রিম কিছু বিলাস বিভ্রম পাচ্ছে।

উপসংহার (বনমহোৎসবের তাৎপর্য):

বৃক্ষ আমাদের মূক সঙ্গী, আমাদের দুঃখ সুখের অনন্তকালের অংশীদার।এক হিসেবে আমাদের জীবনেরই ওপিঠ ওরা। আমরা যে কার্বন-ডাই-অক্সাইড বর্জন করি ওরা তা গ্রহণ করে আবার আমাদের অক্সিজেন ফিরিয়ে দেয়। জীবনধারণের পক্ষে এই অক্সিজেন অপরিহার্য। অতএব বনমহোৎসব করছি মানে, যা হোক কিছু একটা উৎসবের অছিলায় মেতে উঠছি, তা নয়, বিরাট যে জীবনধারা নিখিল বিশ্বজুড়ে প্রবহমান তাকেই নতুন করে বন্দনা করছি। বস্তুত, জীবনের যে মূল উপাদান আলো-বাতাস, জল স্থল ,উদ্ভিদ আর জীব সমাজকে ঘিরে চক্রাকারে আবর্তিত, তাদের সবই যে অদ্ভুত এক ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ, বনমহোৎসব যেন আমাদের তা নতুন করে স্মরণ করিয়ে দেয়। আমরা যেন উপলব্ধি করার সুযোগ পাই, উদ্ভিদ জগতের সঙ্গে যে বিরাট ব্যবধান আমরা গড়ে তুলেছি তা আমাদের অজ্ঞানতা- প্রসূত।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Posts
Scroll to Top