পালস পোলিও টিকাকরণ রচনা(Pulse Polio Vaccination)

ভূমিকা

স্বাস্থ্যকর পরিবেশ দিতে পারে সুস্থ শরীরে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা। দূষণভারে জর্জরিত পরিবেশ বসবাসের যত উপযোগী হচ্ছে দুরারোগ্য রোগের মারণ ফাঁস তত আঁটোসাঁটো হয়ে বসছে শিশু থেকে বুড়ো সব বয়সের মানুষের গলায়। বিশেষ করে এমন কিছু রোগ আছে যা শিশুদের বেশি করে আক্রমণ করে। শিশুর বাসযোগ্য পরিবেশের অভাব হলে, অপুষ্টিতে ভুগলে আক্রমণ হয় ত্বরান্বিত ও অবধারিত। পোলিও রোগের বলি হয় প্রধানত শিশুরাই। অথচ শিশুরাই আগামী দিনের নাগরিক ও জাতির ভবিষ্যৎ। তারা পোলিও রোগাক্রান্ত হয়ে পঙ্গু হয়ে পড়ার অর্থ জাতির পঙ্গুত্বপ্রাপ্তি। তাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা W.H.O- এর ডাকে দেশ থেকে পোলিও রোগ তাড়াতে/ পাঁচের নিচে সব শিশু টিকা নেবে একসাথে স্লোগান সামনে রেখে বিশ্বকে দুরারোগ্য পোলিও রোগমুক্ত করার লক্ষ্যে পালস পোলিও টিকাকরণ অভিযান।

রোগের লক্ষণ,প্রকোপ ও পরিণাম

পোলিও ভাইরাস ঘটিত অসুখ।পোলিও ভাইরাস প্রধানত তিন রকমের। এর যেকোন রকমের ভাইরাসের আক্রমণই ভয়াবহ। এই ভাইরাস বেঁচে থাকে জলেও মলে। জল আর রোগীর মল থেকে ভাইরাস ঢুকে পড়ে সুস্থ শিশুর দেহে। বয়স্ক মানুষের এ রোগ যে হয় না তা নয়,তবে সংখ্যায় খুবই অল্প। শিশুর দেহে রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা কম বলে তারা পোলিও ভাইরাস এ আক্রান্ত হয় তাড়াতাড়ি। পোলিও ভাইরাস খাদ্য বা জল বাহিত হয়ে প্রথমে অন্ত্রে আশ্রয় নেয়। সেখানে মূল বিস্তারের পর দেহের স্নায়ুতন্ত্রের আঘাত হানে। আক্রান্ত অঙ্গ শীর্ণকায় হয়ে পঙ্গু হয়ে যায়। এই পঙ্গুত্বকে সুস্থ অবস্থায় আর ফিরিয়ে আনা যায় না।

পৃথিবীতে 145 টি দেশে এই রোগের ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। তার মধ্যে ভারতে এই রোগের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। বিশ্বের পোলিও রোগাক্রান্ত শিশুর শতকরা ষাটভাগ রোগী ভারতেই। এ দেশে বছরে প্রায় দু- লক্ষ শিশু পোলিও রোগের শিকার হয়। রোগগ্রস্ত শিশুর পঙ্গুত্ব তার জীবনকে শুধু ধ্বংস করে না,সে পরিবারের বোঝা হয়ে পড়ে, বয়স বাড়লে অপরের কৃপা কিংবা ভিক্ষান্নের উপর নির্ভর করে তাকে বেঁচে থাকতে হয়। যেন সমাজের অবাঞ্চিত জঞ্জালে পরিণত হয় সে।

টিকা আবিষ্কার ও প্রয়োগ

জীবাণু তত্ত্ববিদ জোনাস শালক প্রণাম‍্য বিজ্ঞানী, যিনি পোলিও রোগ প্রতিরোধক টিকা আবিষ্কার করেন। তার গবেষণা কাজ ছিল নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবাণু তত্ত্ব বিভাগ। সেখানে তিনি ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগ নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। একদিন হঠাৎ এক পোলিও শিশুর রোগীকে দেখে তার গবেষণার বিষয় বদলে পোলিও রোগের কারণ অনুসন্ধানে তৎপর হন। গবেষণা চলতে থাকে দিনরাত ধরে। বছরের পর বছর কেটে যায়। অবশেষে পোলিও ভাইরাস চিহ্নিত করে তার প্রতিষেধক টিকা ও আবিষ্কার করেন বিজ্ঞানী শালক। জগদবাসীর কল্যাণের উদ্দেশ্যে তার আবিষ্কারের কথা প্রচার করেন। পরবর্তীকালে ডা. স‍্যাবিন পোলিও টিকাকরণ এর ক্ষেত্রে উন্নত প্রক্রিয়া সংযোজন করেন। ইনজেকশনের পরিবর্তে টিকা খাওয়ানোর পদ্ধতি চালু হয়। নির্বিষ পোলিও টিকা শিশুকে কয়েক মাস অন্তর বেশ কয়েকবার খাওয়ালে তার পোলিও প্রতিরোধে ক্ষমতা বাড়ে। তখন পোলিও ভাইরাস শরীরে ঢুকে পড়লেও আক্রমণ করতে পারে না। শিশু ওই ভয়াবহ রোগ থেকে রেহাই পায়।

পালস টিকাকরণ অভিযান

পৃথিবীর ১৪৫ টি দেশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ডাকে সাড়া দিয়ে পালস পোলিও টিকাকরণ কর্মসূচি গ্রহণ করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্টে প্রকাশিত যে, ১৪০ টি দেশ বিগত কয়েক বছর এই পোলিও রোগ নির্মূল করেছে। ভারতের শিশুর চিকিৎসা সংস্থা বা ইন্ডিয়ান একাডেমি অব পেডিয়াট্রির উদ্যোগে পালস পোলিও টিকাকরণ এর কাজ শুরু হয় ২ অক্টোবর ১৯৯৪। সম্প্রতি ৪ জানুয়ারী ২০০৪- এ রূপায়িত পালস পোলিও টিকাকরণের ফলে এদেশে টিকাকরণের বয়স দশ বছর পূর্ণ হতে চলেছে। তাতেও ভারতে পোলিও রোগ নির্মূল হয়নি। কারণ অশিক্ষা, অজ্ঞতা, অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের ফলে পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত সব শিশুকে টিকা করনের শামিল করা সম্ভব হয়নি।

৪ জানুয়ারি ২০০৪ যে টিকাকরণ কর্মসূচি কার্যকরী হয়েছে, সরকারি রিপোর্টে প্রকাশ তাতে পশ্চিমবঙ্গে তিন লক্ষ শিশুকে টিকা খাওয়ানো যায়নি ওই সময়ে পশ্চিমবঙ্গে পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুর সংখ্যা ছিল ৯৪,৪৪,৩১৭। রাজ্যের বিভিন্ন বুথে হাজির ৭০ লক্ষ শিশুকে টিকা খাওয়ানো হয়। পরে বাড়ি বাড়ি ঘুরে কুড়ি লক্ষ শিশুকে খাওয়ানো হয় টিকা। তা সত্বেও তিন লক্ষ শিশু স্বাস্থ্য কর্মীদের নাগালের বাইরে থেকে যায়। ভারতের সব রাজ্যে হয়তো একই অবস্থা নয়। যাইহোক, অদূর ভবিষ্যতে ভারত থেকে পোলিও রোগ নির্মূল হবে, তেমন নিশ্চয়তা কি আশা করা যায় ?

উপসংহার

দেশব্যাপী এ ধরনের অভিযানে সরকারি ও বেসরকারি প্রয়াস প্রচেষ্টার পাশাপাশি সার্বিক গণসচেতনতা একান্ত জরুরী। অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে সহযোগিতার উদার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে না এলে দশ বছর কেন বিশ বছরেও টিকাকরণ অভিযান সাফল্যের মুখ দেখবে না। প্রতিটি শিশুর অভিভাবককে শুধু সচেতন হলেই হবেনা, সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। তবেই শুধু নিজের শিশু নয়, সারা বিশ্বের বর্তমান ও ভাবি শিশু সমাজ হবে পোলিও পঙ্গুত্বের রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত।


Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Posts
Scroll to Top