ভূমিকা
বুকের মাঝে ঘুমিয়ে থাকা শক্তি – সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলে শিক্ষা। শিক্ষা অজ্ঞতার অন্ধকার দূর করে জ্ঞানের আলোয় আলোময় করে। রুচি কে পরিশীলিত করে, আচরণ মার্জিত করে, বিবেক-বুদ্ধি জাগিয়ে তোলে, বোধবুদ্ধির বিকাশ ঘটায়, বিনয় দান করে, পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার প্রয়োজনীয় ক্ষমতা জোগায় শিক্ষা। দেশ ও জাতির সামগ্রিক উন্নতির জন্য শিক্ষার ব্যাপক প্রসার অপরিহার্য। শিক্ষাই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার যোগ্য নাগরিক গড়ার উপযুক্ত হাতিয়া। দুঃখের বিষয়, স্বাধীনতা প্রাপ্তির প্রায় ৫৭ বছর পরেও দেশের সাক্ষরতার হার মাত্র ৬৫.৩৬ শতাংশ। সমগ্র দেশের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের সাক্ষরতার হার একটু উন্নত – পুরুষ ও নারী মিলে সাক্ষরতার হার ৬৯.২২ শতাংশ। অর্থাৎ এই রাজ্যের প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ এখনো নিরক্ষর। যদিও প্রায় এক দশক কাল যাবৎ রাজ্যের ১৮ টি জেলায় পর্যায়ক্রমে সর্বশিক্ষা অভিযান চলেছে সরকারি ও বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে জোর কদমে।
সর্বশিক্ষা অভিযানের উপযোগিতা ও সূচনা
সার্বজনীন শিক্ষা বা সর্বশিক্ষা হলো সকলকে শিক্ষিত করা। শিক্ষার আলো প্রতিটি ঘরে প্রতিটি মানুষের মাঝে পৌঁছে দেওয়া। নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে প্রতিটি মানুষকে মুক্ত করে জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত করা। সর্বশিক্ষা অভিযানের সূচনা হয়েছিল ৮ মে ১৯৯০ এর বিশ্ব সাক্ষরতা দিবসে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্ম ভূমি তখনকার অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলা কে মডেল হিসেবে গ্রহণ করে সর্বশিক্ষা অভিযান তথা সার্বিক স্বাক্ষরতা অভিযান শুরু হয়েছিল।
সর্বশিক্ষা অভিযানের বিভিন্ন পর্ব ও পর্যায়
সর্বশিক্ষা অভিযানের প্রাথমিক পর্ব ছিল দুটি পর্যায়ে বিভক্ত ,এক – বি.এল.সি বা বেসিক লিটারেসি সেন্টার, দুই – পি. এল. সি বা পোস্ট লিটারেসি সেন্টার। এই দুই পর্যায়ে সাক্ষরতার প্রথম ও দ্বিতীয় পাঠ শেষ করা ছিল প্রাথমিক লক্ষ্য। এই লক্ষ্যমাত্রা পূর্ণ হলে সাক্ষরতার তৃতীয় ও চতুর্থ পাঠ শুরু হতো। এই পাঠ পর্বে উত্তীর্ণ স্বাক্ষর কে নিয়ে শিক্ষার যে পর্যায় শুরু হয় তা হলো সাক্ষরতার উত্তম কর্মসূচি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ১৯৯৯ সালে মেদিনীপুর জেলায় যে সাক্ষরতা অভিযান শুরু হয়, পর্যায়ক্রমে রাজ্যের বাকি ১৭ টি জেলাকেই ওই অভিযানের আওতায় আনা হয়। ১৯৯৯-২০০০সালের মধ্যে ১৬ টি জেলায় সর্বশিক্ষা অভিযান বা সার্বিক স্বাক্ষরতা কর্মসূচি বা টোটাল লিটারেসি ক্যাম্পেনের কাজ চুকিয়ে ফেলা হয়। বাকি দুটি জেলা কলকাতা ও দার্জিলিং – এ সার্বিক স্বাক্ষরতা অভিযান চলতে থাকে তার ও পরে।
শিশু শিক্ষা কেন্দ্র
সর্বশিক্ষা অভিযানের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয় ১৯৯৮ সালে ১ জানুয়ারি থেকে। এই কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত হলো শিশু শিক্ষা কেন্দ্র ও মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে পঠন-পাঠন। যে সকল গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই, বা থাকলেও বিদ্যালয় দূরবর্তী হওয়ায় শিশুদের পক্ষে যাতায়াত করার অসুবিধা আছে, কিংবা বিদ্যালয়ে স্থান সংকুলান না হওয়ায় শিশু শিক্ষার্থী নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না, সেই সকল গ্রামে শিশু শিক্ষা কেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে। এরকম শিশু শিক্ষা কেন্দ্রের লক্ষ্যই হলো (৫ – ৯ বছর বয়সের) যে সকল শিশু প্রথাগত শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত নয় তাদের শিক্ষার মধ্যে আনা ,এমনকি যারা সার্বিক স্বাক্ষরতা অভিযান এর মাধ্যমে সাক্ষরতা উত্তর-পূর্বে এসেছে তেমন বেশি বয়সের শিশুকে ও শিক্ষার মূলস্রোতে শামিল করানো।
শিশু শিক্ষা কেন্দ্রের রূপরেখা
সর্ব শিক্ষার প্রসারের জন্য প্রকৃতপক্ষে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে প্রয়োজন ৫৮,২৬১ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়। কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে মাত্র ৫২,৩৮৫ টি। সুতরাং সমগ্র রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় ৫,৮৭৬ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অভাব আছে। প্রধানত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এই ঘাটতি পূরণের জন্য শিশু শিক্ষা কেন্দ্র স্থাপনের অপরিহার্যতা ও স্বীকার্য। শিশু শিক্ষা কেন্দ্র গুলির তদারকির দায়িত্বে থাকছে গ্রাম পঞ্চায়েত। প্রত্যক্ষভাবে দেখভালের দায়িত্বে থাকছে গ্রাম শিক্ষা কমিটি, যার ৭৫ শতাংশ সদস্য অন্তর্ভুক্ত হয় অভিভাবকের পক্ষ থেকে। তার মধ্যে দুজন মহিলা সদস্যের অন্তর্ভুক্তি অপরিহার্য। ৪০ বছরের বেশি বয়সী মহিলারা কেন্দ্রের শিক্ষিকা হিসেবে বার্ষিক চুক্তিতে নিযুক্ত হন। প্রতিবছর চুক্তি নবীকরণ করতে হয়। ২০০০ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত পরিসংখ্যানে দেখা যায় পশ্চিমবঙ্গে ৭,৯২০ টি শিশু শিক্ষা কেন্দ্রে ১৮,৮৫১ জন সহায়িকা নিযুক্ত হয়েছেন এবং শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫.০৫ লক্ষ। শিশু শিক্ষা কেন্দ্রের শ্রেণীবিভাগ,পাঠক্রম, পাঠ্যবই প্রাথমিক শিক্ষার সম্পূর্ণ অনুরূপ।
মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্র
সর্বশিক্ষা কে মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত প্রসারিত করার উদ্দেশ্যে বর্তমান বছর থেকে প্রতি গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীনে একটি করে মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্র গড়ে তোলা হচ্ছে। এখানেও শিক্ষক-শিক্ষিকা নিযুক্ত হচ্ছে চুক্তিভিত্তিতে। মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্রে পাঠক্রম ও পাঠ্যপুস্তক প্রথাগত মাধ্যমিক শিক্ষার সম্পন্ন অনুরূপ।
উপসংহার
সর্বশিক্ষা অভিযান পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলেও এ রাজ্য থেকে নিরক্ষরতার অভিশাপ দূর হবে আশা করা যায়। স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশের প্রতিটি নাগরিক শিক্ষিত হলে গণতন্ত্রের প্রাথমিক শর্ত শুধু পূর্ণ হবে না, গণতন্ত্র সার্থক হবার পথে উল্লেখ্য পদক্ষেপ ঘটবে। শিক্ষার জ্যোতির্ময় আলোয় অশিক্ষা অজ্ঞতার অন্ধকার দূর হওয়ার সমাজ সংসার ও দেশও হবে উন্নত।