জনমত-গঠনে গণমাধ্যম রচনা(Role of Media)

ভূমিকা

আধুনিক বিশ্বে গণতন্ত্রেরই জয়জয়কার। বিশ্বের দিকে দিকে সাম্রাজ্যবাদের ধ্বংসস্তূপের ওপর আজ গণতন্ত্রের বিজয় বিজয়ন্তী দন্তন্য সগৌরবে উড্ডীয়মান। সোভিয়েট রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের পতনের পর গণতন্তের ঘটেছে আত্মপ্রকাশ। অবশ্য , এ কথা অনস্বীকার্য যে ,গণতন্ত্রে মনের গভীরে আজ সমাজতন্ত্রের মূলমন্ত্র কখন নিঃশব্দতার সম্মানিত স্থান করে নিয়েছে। জনমতের সেই গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি। সুগঠিত জনমতের ওপরেই দাঁড়িয়ে থাকা গণতন্ত্রের গগনচুম্বী অট্টালিকা।

জনমত কি? তার সত্য স্বরূপ

জনমত কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়, যুক্তিসম্মত হলেই তবে তা হবে আদর্শ জনমত। কেউ বলেন, সমাজের নানা মতের স্লোগানের সমবায় যে জনমত গঠিত হয়, আদর্শ রাষ্ট্রের তাই-ই মূল বুনিয়াদ। আবার কেউ বলেন, জনমত বিভিন্ন স্বার্থের ভারসাম্যের সুসংহত বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু ওই ইয়ে হো বার্য বাস্তব তথ্যভিত্তিক, সত্যনির্ভর এবং সার্বজনীন ও সার্বভৌম মনোভাবের প্রতিফলন হলেই তা হবে ‘ধন্য রাজার পুণ্য দেশ।’

জনমতই রাষ্ট্রের সার্বভৌম শক্তির প্রকৃত উৎস

গণতন্ত্রে জনমত সরকার-পরিচালনার প্রধানতম হাতিয়ার। এমন-কি প্রবল, জনমত সরকারের পতন ঘটাতেও সক্ষম। ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী কে ও জনমতের প্রবল চাপ পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছে। গণতন্ত্রে লোকায়ত সার্বভৌমত্বই রাষ্ট্রের সার্বভৌম শক্তি। যদি নির্বাচকদের মতামতকে পূর্ণ মর্যাদা দিতে হয় তবে একথা স্বীকার করতেই হবে যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যুক্তিনিষ্ঠ সুচিন্তিত এবং সুগঠিত যতই রাষ্ট্রের সার্বভৌম শক্তির যথার্থ উৎস।
জনমত গঠনের প্রধান কারিগর গণমাধ্যম: দায়িত্বশীল নাগরিকতা সচেতন জনগণ ও গণতন্ত্রের প্রকৃত রক্ষক। সেজন্য ভিন্নমত ভিন্ন পথের নাগরিকদের সুসংগঠিত করা আবশ্যিক। এবং তাই জনমত গঠনে আঁতুড়ঘর ।আধুনিক যুগে মুদ্রণ যন্ত্র বা সংবাদপত্র, বেতার, দূরদর্শন ও চলচ্চিত্র রাজনৈতিক দল সভা-সমিতি, নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও আইনসভা জনমত- গঠনের প্রধান গণমাধ্যম।

মুদ্রণ -যন্ত্র ও সংবাদপত্র

গুটেনবার্গের মুদ্রণ যন্ত্র আবিষ্কারের [পঞ্চদশ শতাব্দী] থেকে বর্তমান লেজার-অফসেট যন্ত্রের আবির্ভাব পর্যন্ত সংবাদপত্র, নানা -পত্র পত্রিকা, প্রচার -পুস্তিকা ইত্যাদি দ্রুতগতিতে মুদ্রিত হয়ে দেশের সুদূরতম অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে জনমত গঠনে অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। সেজন্য প্রয়োজন জনগণের সাক্ষরতা। সংবাদপত্রের সম্পাদকীয়, চিঠি পত্র ইত্যাদি স্বাক্ষর জনগণের মধ্যে জনমত- গঠনের দুয়ার খুলে দেয়। নেপোলিয়ান তাই বলতেন, এক অক্ষৌহিণী সৈন্যদলের চেয়ে একটি বিরুদ্ধে মনোভাব সংবাদ পত্র অনেক বেশি শক্তিশালী। এমন-কি, নির্বাচিত লোকসভার চেয়েও-

‘It the People’s parliament always in session.’

চলচ্চিত্র, বেতার ও দূরদর্শন

জনমত – গঠনের নব-নব গণমাধ্যম সৃষ্টি করে পৃথিবীর দেশে দেশে বিপ্লব এনে দিয়েছে চলচ্চিত্র, বেতার ও দূরদর্শন। হরে হরে নাকি ভারতে ‘প্রসার ভারতী’র পরিচালনায় এগুলো সংগঠিতভাবে কাজ করে চলেছে। ঝড়ের গতিতে জনমত সংগঠনে আজ এদের জুড়ি নেই। নিরক্ষরদের কাছে শ্রুতি ও দৃশ্য অব্যর্থ । ভারতের বেতার- সংগঠন- ‘আকাশবাণী’র বর্তমান সম্প্রচার- কেন্দ্রের সংখ্যা 208। ভারতের দূরদর্শন বর্তমানের উপগ্রহের মধ্যস্থতায় দেশের দূর-দূরান্তকে কাছে টেনে এনে জনমত- গঠনের হয়েছে সক্রিয় প্রতিষ্ঠান।

রাজনৈতিক দলসমূহ

নানা মত নানা পথের পথিক রাজনৈতিক দলগুলি জনমত সংগঠনে পালন করে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সরকারের দুর্নীতিপূর্ণ ও জনস্বার্থবিরোধী কার্যকলাপ ,আঞ্চলিক উপেক্ষা, জাতীয় স্বার্থবিরোধী গৃহীত ব্যবস্থা সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করে তোলার মহান দায়িত্ব পালন করে এই রাজনৈতিক দলগুলি। গণতন্ত্রে বিরোধী দলের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিরোধী দলনেতা একজন প্রধানমন্ত্রী সমপর্যায়ের স্থানাধিকারী ।

সভা-সমিতি সমূহ:

রাষ্ট্রের যে- কোন সমস্যা, জনস্বার্থ -সংক্রান্ত যে-কোন বিষয় সভাসমিতিগুলিতে বিশেষজ্ঞদের দ্বারা আলোচিত হয়। সেখানে বিভিন্ন মতামতের লেনদেন ঘটে এবং সুচিন্তিত পথনির্দেশ করা হয়। তার দ্বারা জনগণ উপকৃত হয়, জনমত- গঠন ত্বরান্বিত করা হয় |

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ

রাষ্ট্রের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির জনমত- সংগঠনের এক নীরব কারিগর। শিক্ষা -প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিভিন্ন বিষয়ের পঠন-পাঠনের মধ্যস্থতায়, বিভিন্ন গ্রন্থকেতাবের সংস্পর্শে এসে ছাত্রদের মধ্যে নীরবে নিঃশব্দে জনমত সংগঠিত হয়ে যায়। আজ যারা ছাত্র, কাল তারাই রাষ্ট্রের নাগরিক এবং জনমতের বিশ্বস্ত বাহক।

আইনসভা

আইনসভা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যন্ত্রের প্রধানতম অঙ্গ। এখানে নানা তর্ক-বিতর্কের মধ্যস্থতায় সরকারি নীতি নির্ধারিত হয়। কাল রূপায়নে নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি ,সরকারের অগণতান্ত্রিক আচরণ, দুর্নীতিপরায়ন ও তার বিষয় আলোচিত হয় এরা ইন সভাতে। সে দিক থেকে আইনসভা জনমতের আয়না।

উপসংহার

জনমত- সংগঠনের ব্যাপারে গণমাধ্যম গুলির মূল্য অপরিসীম। কিন্তু এগুলি বহু ক্ষেত্রে নানা নিয়ন্ত্রণের বেড়াজালে রাহুগ্রস্থ হয়ে তাদের আদর্শচ্যুত হয়। চলচ্চিত্র -দূরদর্শন যৌনতা ও মারামারির চিত্র বিতরনের মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়। সংবাদপত্র হয়ে যায় ধণতন্ত্রের পতাকাবাহী। সরকারের কুক্ষিগত বেতার- দূরদর্শন সরকারি কুকর্মের সমালোচনার ক্ষমতা হারায়। সভা-সমিতি ও আইনসভা গণতান্ত্রিক বিধি- বহির্ভূত আচরণের এবং পেশিশক্তি -প্রদর্শনের রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। কবে আমাদের গণমাধ্যমগুলো সেই সব কদর্যতার রাহুমুক্ত হবে?


Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Posts
Scroll to Top