শিক্ষাবিস্তারে গ্রন্থাগারের ভূমিকা (The Role of Libraries in Education)

মানুষ যখন প্রথম বর্ণমালার অক্ষরগুলি উদ্ভাবন করে প্রস্তর গাত্রে, তামার পাতে, গাছের ছালে, নিজের মনের ভাবনা চিন্তা কে রূপ দিতে পেরেছিল, তখন থেকেই মানব সভ্যতার সূত্রপাত। সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে ধর্ম-দর্শন কাব্য, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ের পুথি গুলি একত্রে সংগ্রহ করে রাখার ব্যবস্থার কথা ও তাকে ভাবতে হয়

ভূমিকা:

মানুষ যখন প্রথম বর্ণমালার অক্ষরগুলি উদ্ভাবন করে প্রস্তর গাত্রে, তামার পাতে, গাছের ছালে, নিজের মনের ভাবনা চিন্তা কে রূপ দিতে পেরেছিল, তখন থেকেই মানব সভ্যতার সূত্রপাত। সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে ধর্ম-দর্শন কাব্য, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ের পুথি গুলি একত্রে সংগ্রহ করে রাখার ব্যবস্থার কথা ও তাকে ভাবতে হয় ,জ্ঞানকে শুধু সমকালীন যুগের জন্যই নয়, পরবর্তীকালের মানুষদের জন্য ও সংগ্রহও সঞ্চয় করে রাখার প্রয়োজনীয়তা সে অনুভব করে, সেই সূত্রেই গ্রন্থাগারের উদ্ভব ।বহু প্রাচীনকাল থেকেই গ্রন্থাগারের সঙ্গে শিক্ষার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক বিষয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিচক্ষণ শাসক ও মনীষীদের সচেতন হতে দেখি

গ্রন্থাগারের ইতিহাস:

সুদূর অতীতে মঠ – মন্দিরের পুরোহিত – যাজক ও সন্ন্যাসী সম্প্রদায় শিষ্য পরম্পরায় ধর্মীয় শাস্ত্র চর্চার জন্য পুথি সংগ্রহ করে রাখতেন, সেখানেই গ্রন্থাগারে সূত্রপাত। টলেমিদের গ্রেকো ইজিপশিয়ান সাম্রাজ্য প্রথম স্থাপন করেছিলেন প্রথম টলেমি তাঁর উদ্যোগে ইজিপ্টের আলেকজান্দ্রিয়া সভ্যতা সংস্কৃতির একটি প্রধান কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়। তার এই রাজধানী পৃথিবীর মননকেন্দ্র, বিভিন্ন প্রান্তের সাহিত্য, শিল্প, বিজ্ঞান, এমনকি ধর্মমত চর্চার ক্ষেত্রে পরিণত হোক, এটাই ছিল টলেমির লক্ষ্য । এখানেই তিনি একটি জাদুঘরও পৃথিবী বিখ্যাত গ্রন্থাগার স্থাপন করেন। আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগারে বহু রচনা সংগৃহীত হয়েছিল। মঠ- মন্দিরের মতো এখানেও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সূচনা লক্ষ্য করি।

১১০০ খ্রিস্টাব্দে বোলোনায়, ১১৫০ খ্রিস্টাব্দে প্যারিসে, ১২২৯ খ্রিস্টাব্দে স‍্যালামাংকায় বিখ্যাত ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয় গুলি গড়ে ওঠে, ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিদ্যার্থীরা এই বিদ্যাচর্চার কেন্দ্রগুলিতে এসে সমবেত হত, ধর্মীয় জ্ঞান ছাড়াও বিজ্ঞান ও রাজনীতি বিষয়ে শিক্ষাদানের জন্য বিশেষ বিশেষ বিভাগ ছিল, গ্ৰন্থাগার ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অপরিহার্য অঙ্গ এবং সমৃদ্ধ। ভারতবর্ষের বিখ্যাত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম পঞ্চদশ শতাব্দীতে। বৌদ্ধ ধর্ম শাস্ত্র ছাড়া নালন্দায়দ ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও অন্যান্য বহু বিষয় শিক্ষা দেয়া হতো। বিখ্যাত চীনা পর্যটক হিউয়েন সাং এর গ্রন্থ থেকে জানা যায় ,নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার ছিল বিরাট, রত্নদধি ,রত্ন সাগর, রত্ন রঞ্জক, ত্রিবেতী বৃত্তান্তে তিন গ্রন্থলয়ের এই নাম পাওয়া যায়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পুঁথির সংগ্রহ দেখে হিউয়েন সাং এর মত পণ্ডিত ব্যক্তি পর্যন্ত চমৎকৃত হয়ে গিয়েছিলেন।পুঁথি পড়ার জন্য আলাদা ঘর ছিল

শিক্ষা বিস্তারে গ্রন্থাগারের ভূমিকা:

মঠ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারগুলি ছিল যাজক সম্প্রদায়, পন্ডিত ও শিক্ষার্থীদের ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ। বিজ্ঞান চর্চার প্রসার ,বিভিন্ন যন্ত্রপাতির উদ্ভাবন ও ব্যবহার ,ধর্ম সংস্কার আন্দোলন,বহির্বাণির্জ্যের বৃদ্ধি – প্রভৃতির সূত্রে ইংল্যান্ডে সপ্তদশ শতাব্দীতে সুদূরপ্রসারি সামাজিক পরিবর্তন ঘটাতে থাকে, এতদিন পর্যন্ত শিক্ষা ছিল সমাজের উচ্চশ্রেণীগুলির মধ্যে সীমাবদ্ধ, এখন থেকে শ্রমজীবী জনসাধারণের মধ্যেও শিক্ষার বিকিরণ শুরু হয়।

এইসব পরিবর্তনের প্রভাবেই ইয়র্কের পার্লামেন্টারি কমিটি মিনস্টার গ্রন্থাগার কে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। এই প্রথম সাধারণ গ্রন্থাগারের সূচনা চার্চ অথবা মিউনিসিপ্যালিটির আওতার বাইরে স্বাধীনতার পরিচালিত প্রথম ইউরোপীয় সাধারণ গ্রন্থাগার ম্যানচেস্টারের চেথ্যামশ লাইব্রেরির সূত্রপাত ১৬৫৩ খ্রিস্টাব্দে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে শিল্প বিপ্লবের পর শ্রমজীবী সাধারণ মানুষদের মধ্যে শিক্ষার দ্রুত বিস্তার ঘটতে থাকে, অবশ্য সমাজের ওপর তলার কিছুসংখ্যক বুদ্ধিজীবী সাধারণ মানুষদের বই পড়ার অভ্যাস পছন্দ করেননি ,বই পড়ার ফলে তারা উদ্ধত ও অবাধ্য হয়ে উঠবে, এই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে ডা: জনসন ইংরেজ পাঠকদের জাতিরূপে বর্ণনা করেছিলেন। অষ্টাদশ শতাব্দী থেকেই সার্কুলেটিং লাইব্রেরী বা ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির প্রচলন শুরু হয় ,সেটিও সমাজের নিম্ন শ্রেণীর মধ্যে বই পড়ার অভ্যাসের বিস্তারে প্রমাণ দেয়

ভারতবর্ষের শিক্ষা বিস্তারে গ্রন্থাগারের ভূমিকা:

বস্তুত শিক্ষার প্রকৃত বিস্তার ঘটে স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌহদ্দির বাইরে সাধারণ গ্রন্থাগারে। সাধারণ মানুষেরা বিভিন্ন এলাকায় জীবিকায় নিযুক্ত থেকেই অবসর সময়ে গ্রন্থাগার গুলি সামরিক পত্র-পত্রিকা ও পুস্তক সংগ্রহ থেকে নিজেদের ইচ্ছামত জ্ঞানের ভান্ডার বৃদ্ধি করা যেতে পারে ।আমরা যে অঞ্চলে থাকি তার ক্ষুদ্র গন্ডির বাইরে স্বদেশ ও বিদেশের বৃহত্তর জীবন, সভ্যতা সংস্কৃতির সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের প্রধানতম উপায় গ্রন্থাগার। আমরা জানি প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অন্যতম মূল্যবান অঙ্গহল গ্রন্থাগার । কিন্তু যেসব সাধারণ মানুষ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ হয়নি, গ্রন্থাগারই তাদের শিক্ষালাভের ক্ষেত্র। সাধারণ গ্রন্থাগার গুলিতে নানা ধরনের আলোচনা সভা ও প্রদর্শনীর আয়োজনের মাধ্যমে ও সাধারণ মানুষদের মধ্যে শিক্ষা ছড়িয়ে দেয়া হয় । জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারে লাইব্রেরীর ভূমিকাকে যে কি গুরুত্ব দেয়া হয়, ইংল্যান্ডের জাতীয় গ্রন্থাগার ঋণ পদ্ধতি থেকেই তার প্রমাণ মেলে।

কোন একটি ছোট শহরের শাখা লাইব্রেরির পাঠক তার প্রার্থিত বই সেখানে না পেলে তার জন্য অনুরোধ জানাতে পারেন, তার অনুরোধ সেই অঞ্চলের প্রধান শহরে অবস্থিত আঞ্চলিক পাঠাগার কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেয়া হয়, সেখানে সেই অঞ্চলের সমস্ত সহযোগী পাঠাগার গুলির পুস্তক সংগ্রহ তালিকা থাকে, তার নিজস্ব সংগ্রহে বইটি না থাকলে এই সংস্থা তাদের কাছ থেকে বইটি সংগ্রহ করতে পারে। এই পদ্ধতিতে ও বইটি সংগ্রহ করা সম্ভব না হলে আঞ্চলিক কেন্দ্র সেই অনুরোধ জাতীয় পাঠাগারে পাঠিয়ে দেয়া, সমস্ত সহযোগী পাঠাগার গুলি তার নিয়ন্ত্রণাধীন। এই ব্যবস্থা একটি স্থানীয় ক্ষুদ্র লাইব্রেরীর পাঠকদের বিপুল পুস্তক সংগ্রহের সব সুযোগ-সুবিধা দিতে সক্ষম হয়।

একটি গ্রামেই জ্ঞানের অনুশীলন ও গবেষণার বিরাট সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায় । ভারতবর্ষের যেখানে অধিকাংশ মানুষেরই শিক্ষার সুযোগ নেই, সেখানে এই ধরনের গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপ অকল্পনীয়। প্রাথমিক বিদ্যালয় তো দূরের কথা, অনেক মাধ্যমিক বিদ্যালয় এমনকি কলেজে পর্যন্ত উপযুক্ত গ্রন্থাগার নেই ,যা আছে তা নামে মাত্র। কোথাও কোথাও বিচ্ছিন্নভাবে সাধারণ গ্রন্থাগার স্থাপিত হয়েছে ,কিংবা ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির ব্যবস্থা করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান বামফ্রন্ট সরকার মফঃস্বল শহর গুলোতে সাধারণ গ্রন্থাগার স্থাপন করেছেন। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় এসব নিত্যান্ত অপর্যাপ্ত।

উপসংহার:

বস্তুত ভারতবর্ষে নিরক্ষরতা দূরীকরণে ও বয়স্ক শিক্ষা কর্মসুচিকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনার মতোই গুরুত্ব দিয়ে তার অঙ্গ হিসেবে প্রতিটি গ্রামের একটি গ্রন্থাগার স্থাপন করতে হবে। এই গ্রন্থাগার গুলিকে শিক্ষা বিস্তারের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করে সাধারন মানুষদের অজ্ঞতা ,কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস থেকে মুক্ত করার ক্ষেত্র করে তুলতে হবে। শহরের কৃষিজীবীরা এখানে নিয়মিতভাবে সাধারন মানুষদের সঙ্গে মিলিত হয়ে যেমন তাদের সমস্যার সঙ্গে পরিচিত হবেন ,তেমনি তাদের সামনে ও তাদের নিজেদের জীবন ও জাতীয় জীবনের অগ্রগতির পক্ষে প্রয়োজনীয় আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের পরিচয় তুলে ধরবেন, সেটাই আমাদের দেশের অর্থনৈতিক সামাজিক উন্নয়নের অন্যতম প্রাথমিক ক্ষেত্র।


অনুরূপ প্রবন্ধ

  • শিক্ষার উন্নয়নের জন্য পাবলিক লাইব্রেরি
  • গ্রন্থাগারের উদ্দেশ্য
  • শিক্ষায় গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তাগ্রন্থাগারের গুরুত্ব
  • পাঠাগারের ভূমিকা

আরও পড়ুন


Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Posts
Scroll to Top